চীনে হওয়া একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় গবেষকদের একটি দল মানব বিকাশের সাথে সম্পর্কিত একটি জিনকে বানরদের জিনোমে প্রবেশ করিয়েছেন। হ্যাঁ, ইতিমধ্যেই গবেষণাটি নৈতিকভাবে বিতর্কিত।
বানরের জিনোমে মানব বিকাশের সেই জিনটি প্রবেশ করাবার পর যে সংশোধিত বানরের জন্ম হল তাদের নিয়ে গবেষকগণ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখা যে এরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে একই জাতের অন্যান্য বানরদের তুলনায় এগিয়ে থাকে কিনা। গবেষণাটি ন্যাশনাল সায়েন্স রিভিউ জার্নাল প্রকাশিত হয়।
গবেষকগণ ১১টি রেশাস বানরের মধ্যে মানব জিন MCPH1 প্রবেশ করিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেবল ৫টি রেসাস বানর তাদের মানসিক দক্ষতা করা সম্ভব এরকম বয়স হওয়া পর্যন্ত বাঁচতে পারে। বাকি বানরগুলো এই বয়সে পৌঁছাবার আগেই মারা যায়।
যাই হোক, এই পাঁচটি ট্রান্সজেনিক বানর নিয়েই মানসিক দক্ষতার বিভিন্ন পরীক্ষা করা হল। দেখা গেল জিন সংশোধন করা হয়নি এমন বানরদের তুলনায় এই ট্রান্সজেনিক বানরেরা স্মৃতির পরীক্ষা বা মেমরি টেস্ট এবং প্রতিক্রিয়া সময় পরীক্ষা বা রিয়েকশন টাইম ট্রায়ালে ভাল করছে।
স্মৃতি পরীক্ষাগুলোর একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একবার বানরদেরকে একটা পর্দার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পর্দায় বিভিন্ন রং এবং আকৃতি ফুটে ওঠে, যেমন লাল রং এর ত্রিভূজ, সবুজ রং এর বৃত্ত।
বানরদেরকে এগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেখানো হয়, আর তারপর তারা এগুলো কিরকম মনে রাখতে পারে তা পরীক্ষা করা হয়।
গবেষক দলটির রিপোর্ট অনুযায়ী, “ট্রান্সজেনিক বানরদের মধ্যে অধিকতর উন্নত শর্ট টার্ম মেমরি বা স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি শনাক্ত করা গেছে।”
এই ট্রান্সজেনিক বানরগুলোর মস্তিষ্কের আকার জিন সংশোধন করা হয়নি এরকম বানরদের মস্তিষ্কের থেকে ভিন্ন ছিল না। তবে ট্রান্সজেনিক বানরদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য বেশি সময় লেগেছে।
মস্তিষ্কের চিত্র বা ব্রেইন ইমেজ এবং মস্তিষ্কের টিস্যু সিলেকশন এনালাইসিস নির্দেশ করছে ট্রান্সজেনিক বানরদের নিউরোনের বিকাশ এবং মায়েলিনেশন বিলম্বিত হয়েছে। মায়েলিনেশন হছে স্নায়ুতন্ত্রের প্রবাহ দ্রুততর করতে সহায়তা করার জন্য স্নায়ুতন্ত্রের চারপাশে আবদ্ধ ঝিল্লি উৎপাদনের প্রক্রিয়া।
গবেষকদের দলটি বলছে, ট্রান্সজেনিক বানরদের মস্তিষ্কের বিকাশের এই বিলম্বন মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশের বিলম্বনের অনুরূপ। মানুষের বিকাশের এই বিলম্বনকে নিওটেনি বলা হয়।
গবেষণাপত্রটির লেখকগণ লেখেন, “মানুষের এবং অ-মানব প্রাইমেটদের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্যদানকারী পার্থক্য হল, মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের নিউরো-নেটওয়ার্কগুলোর বিকাশের জন্য অনেক বেশি সময় লাগে, যা শৈশবকালকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এটাই ‘নিউটিনি’ নামে পরিচিত”।
গবেষণাটি চীনা বিজ্ঞান একাডেমির কুনমিং ইনস্টিটিউট অব জ্যুলোজি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, এখানে নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কিন বিজ্ঞানীদের সাথে অংশীদারিত্বও ছিল। এই পরীক্ষণটি নীতিবিদ্যার আঙ্গিনায় যেন অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছে।
বিজ্ঞান সম্প্রদায়ের অনেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই গবেষণাটি নৈতিক সীমানা অতিক্রম করে, এই বিবৃতি দিয়ে অনেক দেশই এই ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিত না।
কলোরাডো ইউনিভার্সিটির জৈবনীতিবিদ জ্যাকলিন গ্লোভার বলেন, “প্রথম নৈতিক সমস্যাটি এই বিষয়ে যে, এই গবেষণাটি প্রাণীর ব্যবহারের ন্যায্যতা দেবার মত বৈজ্ঞানিকভাবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য, যুক্তিসিদ্ধ বা সুপ্রতিষ্ঠিত কিনা, গবেষণার গবেষণা পদ্ধতিটি বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সক্ষম কিনা – যদি না হয় তবে এখানেই থামতে হবে।”
দ্বিতীয় নৈতিক সমস্যাটি এই বিষয়ে যে, বিশেষ করে বানরকে ব্যবহার করা ঠিক কিনা। এই গবেষণায় কি এমন কোন বিকল্প ব্যবহার করা যেত যা অ-মানব প্রাইমেটদেরকে ঝুঁকিতে ফেলত না?
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম সিকেলা উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের এবং শিম্পাঞ্জি উভয়ের থেকে এমন অরগানয়েড (কালচারের মাধ্যমে গবেষণাগারে তৈরি ক্ষুদ্রাকার অঙ্গ) পাওয়া যায় যা মস্তিষ্কের আণবিক/কোষীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর অনুকরণ করে।
এখন গবেষকদের দলগুলো মানব মস্তিষ্কের জিনগুলি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য জীবন্ত প্রাইমেট ব্যবহার করার বিকল্প হিসাবে শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের অরগানয়েডে মানব জিনগুলো প্রবেশ করাচ্ছে।
যদিও কেউ কেউ গবেষণাটিকে জেনেটিক্স গবেষণার একটি স্লিপারি স্লোপ বলেছেন, অন্যেরা এই বিষয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নন।
হংকং ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর জিনোমিক সায়েন্সেসের গবেষক ল্যারি বাউম এমআইটি টেকনোলজি রিভিউতে বলেন, “রেশাস বানরের জিনোম আমাদের জিনোম থেকে খুব কম শৎকরা হারে ভিন্ন। তাও মানুষের এবং বানরদের মধ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন আলাদা আলাদা ডিএনএ বেস এর ভিন্নতা রয়েছে। গবেষণাটিতে একটি জিনের মধ্যে থাকা হাজার হাজার বেসের মধ্যে মাত্র কয়েকটিকে পরিবর্তিত করা হয়েছে। আপনারা নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে এখানে উদ্বেগের মত কিছু আছে কিনা।”
গ্লোভার বলেন, “গবেষণায় প্রাণী ব্যবহারের নির্দেশিকা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন হলেও একটি সাধারণ অঙ্গীকারবদ্ধ প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে: কোন বিকল্প না থাকলেই কেবল প্রাণীকে ব্যবহার করা যাবে, বৈজ্ঞানিক বৈধতার জন্য সর্বনিম্ন সংখ্যায় প্রাণী ব্যবহার করতে হবে, এবং গবেষণায় মানবিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। এই শেষ শর্তটি মানবায়িত বানর তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং, কারণ বানরের এই মানবায়নের করতে গিয়ে যে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে তা অমানবিক হতে পারে।”
গবেষকদের দলটি বলছে, ঠিক কোন জিনিসগুলো মানুষকে অনন্য করে তোলে এরকম মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তরের গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য অন্তর্দৃষ্টি প্রদানের জন্য ট্রান্সজেনিক অ-মানব প্রাইমেটদের (এপ প্রজাতিসমূহ বাদে) নিয়ে গবেষণায় অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
সেই সাথে অনেক রোগ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন অবস্থা রয়েছে যেমন নিউরোডিজেনারেটিভ এবং সামাজিক আচরণ বৈকল্যের মত সমস্যা যেগুলো অন্য কোন উপায়ে গবেষণা করা কঠিন। এসব ক্ষেত্রেও এই ট্রান্সজেনিক অ-মানব প্রাইমেটদের নিয়ে গবেষণা সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। সূত্র বিবর্তনপথ।
এসডব্লিউএসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ