ডেটা প্রটেকশন আইন ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার পরিবর্তে সরকার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের আশংকা প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি মনে করছে, খসড়া আইনটি চূড়ান্তভাবে পাস হলে তা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের (ডিএসএ) মতো যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ হবে। এই আইন বাস্তবায়ন হলে সরকার ব্যক্তির ওপর নজরদারির ক্ষমতা এর অপপ্রয়োগ এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার হবে।
সোমবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৩ এর খসড়ার ওপর পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে টিআইবি। আইনটির পর্যবেক্ষণে নানা ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে টিআইবি।
ডেটা সুরক্ষা কী?
ফেসবুক, টুইটার এবং গুগলসহ ইন্টারনেটে নানা ধরণের ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ ব্যবহার করছেন বাংলাদেশিরা। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সব তথ্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছে সংরক্ষিত থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে বসে যারা ফেসবুক ব্যবহার করছেন, তাদের প্রতিটি ক্লিকের তথ্য ফেসবুকের কাছে সংরক্ষিত থাকে। যেমন – আপনি কোথায় লাইক দিচ্ছেন, কী শেয়ার করছেন, কোন ধরণের বিষয় সার্চ করছেন – এ সবকিছুই ফেসবুকের ভান্ডারে জমা থাকে। এভাবে প্রতিটি অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটও তাদের ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ করে।
বাংলাদেশ সরকার চায় বাংলাদেশের ভেতর থেকে যারা এসব ব্যবহার করছেন তাদের তথ্যগুলো দেশের ভেতরেই সংরক্ষণ করা হোক। অর্থাৎ সব বিদেশি কোম্পানিকে বাংলাদেশের ভেতরে ডেটা সেন্টারে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রস্তাবিত আইনে কী আছে?
ডেটা বা উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের ভেতরে কোনো কেন্দ্র বা ‘ডেটা সেন্টার’ সংরক্ষণ করতে হবে। মূলত এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মি. হাস।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করতে হলে তার সম্মতি থাকতে হবে। এ ধরণের তথ্য কেউ সংগ্রহ করতে চাইলে ব্যবহারকারীর সম্মতিপত্র দেখা হবে। কোন স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না। যেসব তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে, তা সংগ্রহকারীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। ‘অপ্রয়োজনীয়’ কোন তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না।
প্রস্তাবিত আইনে আরো বলা আছে, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে। যে উদ্দেশ্যে তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনীয় না হলে অথবা মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এসব তথ্য নষ্ট করে ফেলতে হবে। যিনি তথ্য দেবেন, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হওয়ার কোনরকম সম্ভাবনা থাকলে তথ্য নেয়া যাবে না।
যারা তথ্য সংগ্রহ করবেন, তারা কী উদ্দেশ্যে সেটা নেবেন, কেন ও কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা তথ্য দাতাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে। যে উদ্দেশ্যে তথ্য নেয়া হবে, সেটা অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। এসব দেখাশুনা, নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সংস্থা গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক।
কী কী ঝুঁকি আছে?
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়টি নজরদারির জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানানো হলেও, আলোচ্য খসড়ায় উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার নিয়োগ দিবে সরকার। এই এজেন্সিকে আবার যে কোনো নিয়ন্ত্রক/প্রক্রিয়াকারীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যক্তির উপাত্তে, সার্ভারে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে, উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার এবং উপাত্ত মুছে ফেলার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
আর তদন্ত শুরু করার ক্ষেত্রে ‘মহাপরিচালকের কাছে প্রতিয়মান হইলে – এমন বিধান রেখে কার্যত আইনটির যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার বিষয়টি, সরকার নিযুক্ত এবং আবশ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করা হয়েছে।
ঝুঁকির মধ্যে আরও বলা হয়ছে, সরকার নিজেই যেখানে উপাত্ত (ব্যক্তিগত তথ্য) ব্যবহারকারি এবং প্রক্রিয়াকারি, সেখানে সরকার যে আইনটি যথাযথভাবে মানছে, সেটি আরেকটি সরকারি সংস্থা কীভাবে নিশ্চিত করবে, তা বোধগম্য নয়।
এতে আরো বলা হয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বের এমন নজির নতুন করে যে আশঙ্কার জন্ম দেয়, তা হলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো এই আইনেরও যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ হবে। ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে সরকারের মদদে। সরকারের মত বা অবস্থানের বিরুদ্ধে গেলে যে-কোনো সংস্থার সার্ভারে ঢুকবার, উপাত্ত মুছে ফেলার এবং উপাত্ত প্রক্রিয়া করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে।
ফলে সরকারের ব্যক্তির ওপর নজরদারির ক্ষমতা, এর অপপ্রয়োগ এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রন আরও জোরদার হবে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আলোচ্য খসড়ায় তিন ধরনের উপাত্তের কথা বলা হয়েছে, সংবেদনশীল উপাত্ত, ব্যবহারকারী সৃষ্ট উপাত্ত ও শ্রেণিবদ্ধকৃত উপাত্ত (classified data) যা দেশের সীমানার ভিতরে মজুতের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি উপাত্ত স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপের কথা বলা হয়েছে।
এর ফলে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা হলো, দেশের সীমানার ভিতরে উপাত্ত মজুত করার বিধান রেখে কার্যত উপাত্তের উপর নজরদারির এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়েছে। সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সির প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং এর বিপরীতে অপব্যবহারের রোধের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, আলোচ্য খসড়াটি নিশ্চিতভাবে জনগণের সংবিধানস্বীকৃত বাকস্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং জনগণের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ওপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি জোরদার হবে।
ছোট ও মধ্যম পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপাত্তের স্থানীয়করণ ব্যয়বহুল হওয়ায়, তারা প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে। পাশাপাশি সব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তার ব্যয়ও বাড়বে।
টিআইবির গরেষণায় দেখা গেছে, উপাত্ত স্থানান্তরের ওপর কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে তার ভিত্তিতে দেশের ডিজিটাল রপ্তানি ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। প্রবৃদ্ধির হার কমতে পারে ০.৫৮ শতাংশ। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে।
খসড়ায় যা বলা হয়েছে
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে, কোম্পানির প্রত্যেক মালিক, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা প্রতিনিধি উক্ত অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন, যদি না তিনি। প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, সেই অপরাধ তাঁর অজ্ঞাতসারে হয়েছে বা অপরাধ রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।
এই ধারার মাধ্যমে ফৌজদারি আইনে অপরাধ প্রমাণের দায়সংক্রান্ত নীতির সরাসরি বিপরীত ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে, নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সব প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ দেশি বিদেশি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য আইনগত ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এবং ফৌজদারি কার্যবিধির প্রয়োগের বিধান রাখার কারণে এই ঝুঁকি কেবল আর্থিক দণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের হয়রানির যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে উপাত্ত সুরক্ষা আইন দিয়েও তেমন কিছু করা হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম, ডেটা প্রটেকশন এক্সপার্ট ড. তরিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
আপনার মতামত জানানঃ