সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের মৃত্যু নতুন ঘটনা নয়। কারণে-অকারণে সীমান্তে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। ভারতীয় সীমানায় কোনো বাংলাদেশির মৃত্যু হলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয় মরদেহ।
দুই দেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় পর্যায় এবং সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু হত্যা বন্ধ হচ্ছেই না। উল্টো গুলিতে মৃত্যুর পর সীমান্ত থেকে মরদেহই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক সময় ফেরত চাইলেও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে টালবাহানা।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে গত সাত বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ২২১ বাংলাদেশি এবং আহত হয়েছেন আরও প্রায় আড়াই শ। এদের মধ্যে এক বছরেই বিভিন্ন সীমান্তে গুলিতে মারা যাওয়ার পর মরদেহ ফেরত পাওয়া যায়নি ছয়জনের।
এরই ধারাবাহিকতায় লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তর্ক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিত এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরেকজন।
গতকাল শনিবার রাত ১১টার দিকে জগতবেড় ইউনিয়নের ভেরভেরীরহাট সীমান্তে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত বাংলাদেশি পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়নের কলাবাগান এলাকার রবিউল ইসলাম (৫২)। একই গ্রামের আহত ব্যক্তি সহিদুল ইসলাম (৩৫) রংপুরের একটি হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জানা গেছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ৮৬৪ নম্বর প্রধান পিলারের জগতবেড় ইউনিয়নের ভেরভেরীরহাট এলাকা সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু পারাপারকারীদের সহায়তায় বাংলাদেশি গরু পারাপারকারীসহ উভয় দেশের ৭ থেকে ৮ জনের একটি দল গরু পারাপারের চেষ্টা করতে থাকে।
শনিবার রাত ১১টার দিকে ওই দলের মধ্যে রবিউল ও শহিদুল সীমান্তে যায়। এ সময় ভারতীয় ১৬৯ রাণীনগর বিএসএফ ব্যাটালিয়নের চেনাকাটা ক্যাম্পের টহল দলের সদস্যরা ভারত-বাংলাদেশের গরু পারাপারকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে রবিউল ইসলাম কোমড়ের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়।
এ ঘটনায় শহিদুলকে আহতাবস্থায় তার সঙ্গীরা উদ্ধার করে রাতেই রংপুরে নিয়ে যায়। বর্তমানে রংপুরের একটি হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বলেন, নিহত রবিউলের লাশ তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়।
লাশ ময়না তদন্তের জন্য লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। শহিদুল রংপুরে চিকিৎসাধীন বলে শুনেছি।
বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ তিস্তা ব্যাটালিয়ন-২ (৬১ বিজিবি) এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম মাহবুবুল আলম খান ও উপঅধিনায়ক মেজর নাজমুস সাকিব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনাস্থলে নিহতের ব্যাপারে তদন্ত কার্যক্রম চলমান।
ঘটনাস্থলের কাছে উভয় দেশের কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে সকালে পতাকা বৈঠক হয়েছে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে শমসের নগর ক্যাম্প কমান্ডার বেলাল হোসেন ও ভারতের পক্ষে চেনাকাটা ক্যাম্প কমান্ডার বারোরাম শিং এর নের্তৃত্বে সভা হয়। সভার আলোচীত বিষয় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৯০ ভাগকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ অথচ বাংলাদেশ-ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় সীমান্তে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার না করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে গত বছরের জানুয়ারিতে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
মূলত বন্ধু রাষ্ট্রের গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
এসডব্লিউএসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ