প্রথম আলো-ঢাকা ট্রিবিউনসহ বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সাম্প্রতিক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের (এমএফসি) ১২ সদস্য। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এমএফসি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এমএফসি বলছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিলের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার সাংবাদিকের ভাইয়ের ওপর হামলা, ঢাকা ট্রিবিউনের আলোকচিত্রী সাংবাদিকের ওপর হামলা এবং সম্প্রতি প্রথম আলোর সাংবাদিক আটকের খবরে তারা উদ্বিগ্ন।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রতিটি ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন।
এমএফসির সদস্য হিসেবে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে—অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
তুলে নেওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর কারাগারে
সিআইডি পরিচয়ে সাভারের বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।
তুলে নেওয়ার ৩০ ঘণ্টা পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাকে কারাগারে আটক রাখার জন্য আদালতে আবেদন করে রমনা থানার পুলিশ।
অন্যদিকে শামসুজ্জামানের পক্ষে তার আইনজীবীরা জামিন চেয়ে আবেদন করেন। সে আবেদনের শুনানি শুরু হয় বেলা দুইটার দিকে। তখন হাজতখানা থেকে শামসুজ্জামানকে আদালতে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়। শুনানি শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন।
এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে তাকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়।
গত বুধবার ভোর চারটার দিকে সাভারের বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না শামসুজ্জামানের। তিনি প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে সাভারে কর্মরত।
তুলে নেওয়ার পৌনে দুই ঘণ্টা আগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম মামলা হয়। এ মামলার বাদী যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া।
মধ্যরাতে মামলা
প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়ার ২০ ঘণ্টা পরও যখন তার খোঁজ জানা যাচ্ছিল না, এমন একটা অবস্থায় খবর আসে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে।
কিন্তু মামলাটি নিয়ে অনেকটা লুকোচুরি করে রমনা থানা-পুলিশ। ওই রাতে মামলার বিষয়ে রমনা থানার পুলিশ প্রথমে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। এ বিষয়ে জানতে বুধবার মধ্যরাতে প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক রমনা থানায় গেলে তাদের থানার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি পুলিশ।
এ সময় থানার সামনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিক অবস্থান করেছিলেন। তাদেরও থানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে রাত ১টা ৫৫ মিনিটে মামলার বাদী আবদুল মালেকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো।
তিনি নিজেকে হাইকোর্টের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘মামলাটার আমি এজাহার দায়ের করেছি, হয়েছে (মামলা) কি না, জানি না। হয়েছে কি না, ওরা (পুলিশ) যোগাযোগ করেছে কোথায় কোথায়, পুলিশের ব্যাপার তো, বোঝেন না।’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ।
গতকাল বৃহস্পতিবার পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সংবাদকর্মীরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
তারা অবিলম্বে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রতিবেদক শামসুজ্জামান এবং যুগান্তর–এর বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাসহ এই আইনে সংবাদকর্মীদের নামে যত মামলা হয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানান। একই সঙ্গে শামসুজ্জামানের মুক্তি দাবি করা হয়।
সম্পাদক পরিষদ বলেছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের সংবাদপত্রশিল্প ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত।
প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে তাকে হয়রানি ও তার পত্রিকার সাহসী সাংবাদিকতাকে ভয় দেখানো হচ্ছে বলে মনে করে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)।
নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদের সই করা বিবৃতিতে প্রথম আলো সম্পাদক ও নোয়াবের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের মুক্তি দাবি করা হয়। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায় সংগঠনটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ আমাদের কাছে শঙ্কাজনক মনে হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে আমাদের আপত্তি জানিয়েছি। এ ধরনের আইন মুক্ত মতপ্রকাশ, স্বাধীন সাংবাদিকতা তথা প্রাগ্রসর সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ও পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। দুই সংগঠনের নেতারা অবিলম্বে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে বিনা পরোয়ানায় ভোররাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা হয়রানিমূলক।
এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে। এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে এবং ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে।
প্রথম আলোর সাংবাদিককে গভীর রাতে তুলে নেওয়া এবং ৩০ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এক বিবৃতিতে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৩৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ