মনজুরুল হক
সরকারের আর ট্রাফিক পুলিশের কাজ মোটামুটি একইরকম। ব্যস্ত রাস্তায় কোনো ন্যাংটা পাগল ভড়ং ধরে দাঁড়ালে তাকে ধরে পাগরাগারদে পাঠানো। কোনো ফেরববাজ নামাজে দাঁড়িয়ে স্ট্যান্টবাজী করলে কান ধরে মসজিদে পাঠানো। এ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ারফাইটারের গাড়ি আসলে সব বন্ধ করে ওই গাড়িকে পাসিং দেওয়া ট্রাফিকের কাজ। তেমনি কোনো একটা সম্প্রদায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করে আরেকটা সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করলে সরকারের দায়িত্ব কঠোরভাবে ট্রাফিকিং করা, কিন্তু বাংলাদেশের সরকার সেসব করতে ব্যর্থ। গত শুক্রবারে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জামাতের সালানা জলসায় সংখ্যাগুরু সুন্নি মুসলিমরা দলবেধে আক্রমণ করে একজনকে হত্যা করেছে। সরকার বরাবরের মতই ব্যর্থ হয়েছে সেটা ঠেকাতে।
নিহত জাহিদ হাসান আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ছিলেন বলে প্রচারে এসেছে। আবার তার পরিবার বলছে; না, তারা আহমদিয়া নয়। জাহিদ আহমদিয়া হোন বা না হোন তাতে তার মৃত্যু জায়েজ হয় না। জাহিদের মৃত্যুর পরে সৃষ্ট সংঘাতে পুলিশের গুলিতে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এবং বরাবরের মতই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পুলিশি ভূমিকায় সরকার সন্তুষ্ট। কেন? এধরণের ঘটনা ঘটানোর সাহস হয় কী করে? আমরা এই উপমহাদেশের ক্লেদাক্ত ইতিহাস থেকে জানতে পারি—‘সরকার না চাইলে সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা হতে পারে না।‘
সরকারের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যত ইন্সট্রুমেন্টস আছে তা দিয়ে যে কোনো ঘটনা ঘটার আগে তাদের জানতে পারার কথা। তাহলে প্রশ্ন ওঠে-সরকার কি দাঙ্গা চাইছে? দেশের সংখ্যাগুরু সুন্নি মুসলিমরা যে খোদ খোদার উপর খুদগারি করছেন সেটা কি সরকার জানে না? কে তাদের এই অধিকার দিল? আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ও মুসলিম। তার পরও কেন তাদের উপর যুগ যুগ ধরে আক্রমণ চলছে?
ইতিহাস বলছে কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা করার দাবী পাকিস্তান জামাতে ইসলামি শুরু করেছিল ১৯৫১ সালে। তাদের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওদুদীর নেতৃত্বে কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা করে পাকিস্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়েছিল। পাঞ্জাব প্রদেশজুড়ে সেই দাঙ্গায় দশ হাজারের উপর কাদিয়ানী মুসলিমদের হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মওদুদীকে পাকিস্তানের আদালত অভিযুক্ত করে এবং তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেয়। কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশের দূতিয়ালিতে ধুরন্ধর মওদুদী তৎকালীন পাকিস্থানের সামরিক শাসকের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রাণ ভিক্ষা চায়। আর তা মঞ্জুরও হয়।
আজকের বাংলাদেশে এখন আর শুধু জামাতে ইসলামি নয়, সঙ্গে আরও ডজন ডজন মজহাব/ দল-গোষ্ঠি আহমদিয়াদের নির্মূল করতে চায়। তাদের দাবি-আহমদিয়ারা ‘অমুসলিম’। কী ভয়ঙ্কর কথা! ‘অমুসলিম’ হলেই কতল করতে হবে? আর সেই অপচেষ্টা সরকার বসে বসে দেখবে? এটা কি আধুনিক গণতন্ত্র? যার ফেনায়ীত বয়ান অহরাত্র চব্বিশ ঘন্টা ধরে প্রচার হয়? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম-আহমদিয়ারা ‘অমুসলিম’। তাহলে যারা সরাসরি অমুসলিম সেই হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ সম্প্রদায়কেও কি নির্মূল করতে হবে? আপনারা কি সেই পথে হাঁটছেন না? আজকে সরকারের নিতনির্ধারকরা (কোথায় আর নীতিনির্ধারক? সবই তো ওয়ান পার্সন আইডোলজি) ভাবছেন- “রহিমুদ্দির ঘরে আগুন লাগলে আমাদের কী? আমরা তো মারতে যাইনি। তা ছাড়া আমরা তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাহারা দেওয়ার জন্য বসে নেই!”
না জনাব। এখানেই এসব এনার্কির শেষ নয়। এটা কেবল শুরু। আপনারা আজকে যারা চুপ করে গ্যালারিতে বসেছেন, তারা হয়ত কালকেই দেখতে পাবেন কাদিয়ানীদের নির্মূলের পর টার্গেট অন্যান্য অমুসলিম। তার পরের টার্গেট প্রগতিশীল-কথিত নাস্তিক-কমিউনিস্টরা। তারও পরের টার্গেট যে আপনারাও সেটা আপনাদের ক্ষমতাদর্পী মাথায় আসছে না। আপনারা ভাবছেন এভাবেই বাকি জীবন কেটে যাবে….।
আপনারা স্বীকার করুন বা না করুন জনসাধারণ জানে আপনারা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে যত রকম রাষ্ট্রীয় টুলস ব্যবহার করতে হয় সব করবেন। এমন সব ম্যাকানিজম করবেন যাতে করে বছরের পর বছর আর কোনো দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না। সেই মাহেন্দ্রসুখের স্বপ্নে আপনারা যাদের দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন, টাকা-পয়সা, দান-খয়রাত, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মোটাতাজা করছেন তারাই আপনাদের রক্ষাকর্তা হবে? ভুল। এই চিন্তা এমনই ভুল যে চূড়ান্ত সময়ে যার কোনো রেমেডি হবে না। পাকি.স্তানও আফ.গানি.স্তান থেকে সোভিয়েত তাড়াতে ঠিক এই পদ্ধতি নিয়েছিল। ফলাফল: আজকে পাকি.স্তান দেউলিয়া। এমন কোনো জুম্মাবার নেই যেদিন পাকি.স্তানের কোথাও না কোথাও মসজিদে বোমা হামলায় ডজন ডজন মানুষের মৃত্যু ঘটে না। আমরা কি অমন বাংলাদেশ দেখতে চাই?
আপনার মতামত জানানঃ