সাধারণ মানুষ আগে থেকেই জানত। পত্র-পত্রিকায়ও বিভিন্ন সময় খবর এসেছে। তবে এবার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণার বরাতে সেই অভিযোগই সত্য প্রমাণ হলো। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বন বিভাগের ব্যর্থতায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। এই দখলে প্রভাবশালীদের পাশাপাশি প্রশাসনের ভূমিকাকে দায়ি করেছে তারা।
টিআইবি বলছে, বন উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পাওয়ার পেছনে বনকেন্দ্রিক অনিয়ম ও দুর্নীতির ভূমিকাই প্রধান কারণ। দেশের বন ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব বন অধিদফতরের ওপর ন্যস্ত। অথচ বনভূমি দখল ও ধ্বংস হলেও তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। পুরনো বন আইন, সনাতন পদ্ধতিতে বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাসহ কার্যকর তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে বন অধিদফতরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
৩০ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল বুধবার সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। এতে বলা হয়েছে, বন অধিদপ্তরের বিভিন্ন নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নের একাংশের ক্ষেত্রে বিধিবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রধান বন সংরক্ষকদের একাংশসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ, পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে পদভেদে ৫০ হাজার থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বিধিবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সামাজিক বনায়নের সুবিধাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্তি ও প্রকল্পের আওতায় সামাজিক বনায়নের প্লট প্রাপ্তিতে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা, নথিপত্রে স্থানীয় ভূমিহীনদের না দেখিয়ে বাস্তবে প্রভাবশালীদের প্লট বরাদ্দে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা সংশ্লিষ্ট বনকর্মীরা আদায় করে।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারিত না হওয়া এবং এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। বন অধিদফতরের সব স্তরের কার্যালয়ের কর্মকাণ্ডে কার্যকর তদারকি, পরিবীক্ষণ, জবাবদিহি ও ফরেস্ট্রি পারফরম্যান্স অডিটর অনুপস্থিতিতে বন অধিদফতরকেন্দ্রিক দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
এছাড়া ৯৩ বছরের পুরনো বন আইন, ১৯২৭-এর কার্যকর প্রয়োগে প্রয়োজনীয় বিধিমালা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও আমূল সংস্কারের জন্য কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। বন অধিদফতরের কর্মকাণ্ডে বননির্ভর জনগোষ্ঠীর কার্যকর অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে সুবিধাভোগী হিসেবে বননির্ভর আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি বন সুরক্ষা অধিদফতরের প্রধান দায়িত্ব হলেও তা পালনে প্রতিষ্ঠানটির সুস্পষ্ট ব্যর্থতা ও বিচ্যুতির সুনির্দিষ্ট উদাহরণ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বন অধিদফতর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকারক হবে বলে চিঠি মারফতে উল্লেখ করলেও পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের পর বন অধিদফতর ওই প্রকল্পের আর বিরোধিতা করেনি।
তাছাড়া বন্য হাতিসহ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যানসমূহের (যেমন ডুলাহাজরা ও মেধাকচ্ছপিয়া) মধ্য দিয়ে দোহাজারী-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে অধিদফতরের সম্মতিজ্ঞাপন সংস্থাটির ওপর অর্পিত ক্ষমতা ও দায়িত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন অধিদফতরের শুধু লিখিতভাবে আপত্তি জানানোতেই সীমাবদ্ধ থাকার অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই পর্যন্ত বনভূমির প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ২৪০ একর জমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ করে নিয়ে গেছে।
গবেষণায় বলা হয়, এই পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি জবরদখল করা হলেও অধিদফতর সর্বশেষ পাঁচ বছরে মাত্র ৮ হাজার ৭৯২ একর (৩%) জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধারের পরিমাণ কম হওয়ার পেছনে বন অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বনভূমির জমির দলিল ও নথিপত্র অধিদফতরের কাছে চূড়ান্ত অবস্থায় না থাকা ও যথোপযুক্ত উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যমতে, বদলি নীতিমালা উপেক্ষা করে বনকর্মীদের নিজ জেলায় বদলি ও পদায়ন করা হয়। স্থানীয় ভূমি অফিস, সেটেলমেন্ট ও সাবরেজিস্ট্রার অফিসের কর্মী ও বনকর্মীদের একাংশের যোগসাজশে ভুয়া দলিল ও নথি তৈরি এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ডভুক্তির অভিযোগ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে মাঠপর্যায়ে নগদ অর্থ বণ্টনকালে ডিএফও, রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তাদের একাংশ ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৬১ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এসডাব্লিউ/ডিআর/নাসি/আরা/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ