মাহবুব আরিফ কিন্তু
এক.
ড. তসলিমা নাসরিনের লেখা অনুসারে বলতে হয় আমাদের সমাজে নারীকে নানান রকম মানবতাবিরোধী পরিস্থিতিতে পড়তে বাধ্য করা হয়। সে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছে না। তাদের নারীসুলভ সংবেদনশীলতা প্রকাশের অধিকার কিছু নির্দিষ্ট স্থানে তথা সমাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে পূর্ণ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে; এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মানবতা দর্শনের আলোকে তসলিমা নাসরিনের লেখা, ভাষা, বর্ণ এবং শ্রেণী সমস্ত লেখায় চরিত্রগুলিকে বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বিষয়গুলি যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন, একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের সাথে কখনোই মর্যাদাপূর্ণ মানানসই আচরণ করেনি।
যে সমাজে নারীদের তুচ্ছ করার মতো অনেক আবেগপূর্ণ অনুভূতিকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়, পুরুষ কি সমাজে নারীদের সমান তালে স্বাধীন ভাবে জীবন ধারণ করার পথকে ও সমস্ত মানুষের সাথে যোগাযোগের সুযোগকে রুদ্ধ করা হয়। এসবের কারণ হিসাবে আমি বলতে চাই সমাজে ধর্ম ও এর বিধানকে গুরুত্ব দেবার কারণেই পুরুষ ও নারীদের সমান অধিকারকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যেখানেই অন্যায়-অবিচার দেখেছেন – ড. তসলিমা নাসরীনের কলম ঝলসে উঠেছে। অনেকের ধারণা তসলিমা নাসরিন ধর্ম বিদ্বেষী; আসলে বিষয়টি মোটেই তা নয়। অনেকেই ধরে নিয়েছেন তসলিমা নাসরিনের লেখা ধর্মকে অবমাননা করেছে, সত্যি কথা বলতে যারা এসব অপবাদ দিয়ে বেড়ায় তারা কেউই তসলিমা নাসরিনের পুরো একটা বই কখনোই পাতা উল্টিয়ে পড়েননি।
ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিন কথা বলেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে, মানবতার স্বার্থে তসলিমা নাসরিন কলম হাতে তুলে নিয়েছেন। আর তাই যদি না হবে তবে অজানা কারণে নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত লেখক তসলিমা নাসরিন এতগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতেন না। যারা এই পুরস্কার দিচ্ছে তারা নিশ্চয়ই গর্দভ পর্যায়ের কেউ নন। দৃঢ়তা এবং স্বনির্ভরতার সাথে জীবনের চরম দুর্যোগের মুহূর্তেও তিনি মানুষকে ভুলতে পারেননি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি দেশ, মানুষ ও সমাজের কথা ভেবেছেন; যেটা আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে হয়তো খুবই দুরূহ বিষয়। তসলিমা নাসরিন এগিয়ে যাবেন এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সমাজে মানবতা প্রতিষ্ঠায় যে ধরনের উদ্বেগগুলি বাংলাদেশী সমাজে খোলামেলা ভাবে আলোচনা করা হয় না, যে সমাজে এসব আলোচনা করতে গেলে ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত দেয়া মনে করা হয়, যে সমাজে যৌনতার কথা আলোচনা মানে ধর্মের দৃষ্টিতে চরম অন্যায় – সেই সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে তাকে হত্যা করার হুমকি দিলেও জাতি নীরব ভূমিকা পালন করে। আজ তসলিমা নাসরিন সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেই সমাজের কথা লিখে যাচ্ছেন, এর চাইতে সমাজের বড় পাওয়া আর কী-ই-বা থাকতে পারে?
তসলিমা নাসরিন একজন বাংলাদেশী লেখিকা। তিনি বাংলায় লেখার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তার লেখার অনুবাদ ইংরেজি, হিন্দি এবং অন্যান্য অনেকগুলো ইউরোপীয় ভাষা প্রকাশ করা হয়েছে। “লজ্জা” বইটি প্রকাশের পর তিনি বিশ্বের দরবারে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বাঙালী জাতি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের জন্যে ড. তসলিমা নাসরিন একজন গৌরব করার মতো সম্পদ। আর আজ কিনা তাঁর নিজ দেশে ফিরে আসার জন্মগত অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত।
দুই.
সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, কাজ থেকে আজ ছুটিও নিয়েছি এই বুঝি উনার ফোন এলো। ঠিক দুপুর বেলার শেষ প্রান্তে ফোনটা বেজে উঠতেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো একজন নিরহংকার ও মানুষের মানবতার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে কোটি মানুষের অনুপ্রেরণায় যার কলম সদা জাগ্রত সেই তসলিমা নাসরীনের কণ্ঠ। যে মানুষটি নিজ দেশে থেকে কোন কারণ ছাড়াই নির্বাসনে আছেন, শত চেষ্টাতেও যিনি দেশে ফিরে আসতে পারছেন না। সরকারী কোন প্রজ্ঞাপন না থাকলেও কি যেন কোন এক অজানা কারণে কোন সরকারই তাঁকে দেশে আসার অনুমতি দিতে নারাজ। “আচ্ছা, এ দেশে তো ইলিশ পাওয়া যাবে তাই না, আজ রাতে তাহলে সর্ষে ইলিশের ঝোল দিয়ে গরম ভাত হয়ে যাক।”
সেদিন রাতের খাবারটা আমরা সবাই ইলিশের ঝোল দিয়েই করেছিলাম বটে, তবে আজ? আজ আমার মনের ভেতরের কষ্টটা আবার যেন অন্তরের মাঝে চিনচিন করে উঠলো। যে মানুষটির দেশের সংস্কৃতি, দেশীয় খাবার, দেশের মানুষের প্রতি এতটাই টান – আজ সেই তাকেই কিনা নিজ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে? দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কি এক অসাধারণ উন্নতি হয়েছে। চারিদিকে হৈহৈ কাণ্ড রইরই ব্যাপার; কিন্তু সেই দেশেরই একজন নাগরিকের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে এক ভিন দেশের হাসপাতালে। ভুল চিকিৎসা ও ডাক্তারদের অবহেলার কারণে তাঁকে পঙ্গুত্বের ভার বহন করতে হলে দেশের মানুষ সরকারের কি কিছুই করার নাই? একজন নাগরিকের প্রতি দেশের কোনই দায় দায়িত্ব থাকবে না? মানুষের প্রতি মানুষের মানবতা, ভালবাসা ও দায়িত্ব সব কিছুই কি আজ হারিয়ে গেল? তিনি তো সুইডেনেরও নাগরিক বটে। তিনি খানিক সময় নিয়ে বুদ্ধি করে বিষয়টি সুইডেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় বা আমাদের জানতেন তবে আজ হয়তো তিনি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ হাসপতাল ক্যারোলিনস্কাতে চিকিৎ পেয়ে যেতেন।
খুবই দুঃখজনক ঘটনা! তাসলিমা নাসরিনের অতি সত্তর সুইডেনে চলে আসা উচিত ছিল। যে দেশে বিনে পয়সায় নাগরিকদের সর্বশ্রেষ্ট মানের চিকিত্সা দেয়া হয়, যে দেশ থেকে এয়ার এম্বুলেস পাঠিয়ে তার নাগরিকদের নিয়ে এনে সঠিক চিকিৎসা দেয়া বা পাওয়া নাগরিকের অধিকার, সেই দেশের নাগরিক হিসাবে আপনার এখানে চলে আসা প্রয়োজন। কারণ অপারেশনের পরেই সঠিক ফলোআপ বা দীর্ঘ মেয়াদী পর্যবেক্ষণ অথবা Rehabilitation এর প্রয়োজনে আপনাকে চলে আসাটা খুবই জরুরী। শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বেই আপনাকে ভালবাসার কোটি কোটি মানুষ রয়ে গেছে। Taslima Nasrin আপনি চলে আসুন, আমরা অনেকেই এক জীবন আপনার পাশে থাকতে চাই ও আছি।
পরিশেষে তসলিমা নাসরিন, আপনি ভালো থাকবেন, অনেক অনেক সুস্থ থাকবেন।
আপনার মতামত জানানঃ