বাংলাদেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তা মনিটর করবে ঢাকাস্থ বন্ধু এবং উন্নয়ন সহযোগী ৯ দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডের সিনিয়র কূটনীতিকরা এ নিয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা বৈঠক করবেন।
বৃহস্পতিবার ওই দেশের প্রতিনিধিদের এক সমন্বয় সভা থেকে এ ঘোষণা আসে। মার্কিন দূতাবাসের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি) নামের বৈশ্বিক জোটের সদস্য ওই ৯ দেশের কূটনীতিকরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন আজ (৯ই ফেব্রুয়ারি)।
তারা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর ‘সেন্সরিং’ এবং সাংবাদিকদের ‘হয়রানি ও ভয় দেখানোর’ সাম্প্রতিক ঘটনাসহ বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত বর্তমান গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ এবং উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সুশীল সমাজের সদস্য ও সাংবাদিকেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত তাদের কাজের বর্ণনা দেন।
মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অফ মিশন হেলেন লা-ফেইভ ঢাকায় এমএফসির কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক উদ্যোগ চালু করার জন্য এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সমর্থনের জন্য উপস্থিত প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান। সুশীল সমাজের সদস্য ও সাংবাদিকরা ঢাকার উদ্বোধনী বৈঠকে উপস্থিত হয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত তাদের কাজের বর্ণনা দেন।
উপস্থিত প্রতিনিধিরা মিডিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি, অনলাইন নিউজ পোর্টালের সেন্সরিং এবং সাংবাদিকদের হয়রানি ও ভয় দেখানোর সাম্প্রতিক ঘটনাসহ বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এমএফসি বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সমর্থন করার জন্য মিডিয়া, সুশীল সমাজ, সরকার এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে এখন থেকে বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত আলোচনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এটি একটি ক্রস-আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব যা অনলাইন এবং অফলাইনে মিডিয়ার স্বাধীনতার সমর্থনে একসঙ্গে কাজ করে।
সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীদের নিরাপত্তাকে সমর্থন করে এবং যারা সাংবাদিকদের ক্ষতি করে তথা মিডিয়ার কাজকে কঠোরভাবে সঙ্কুচিত করার অপচেষ্টা চালায় তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কাজ করে।
বিজ্ঞপ্তি মতে, ডিপ্লোম্যাটিক নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভ সারা বিশ্বের সদস্যদের নিয়ে গঠিত। এমএফসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক মিশনসমূহ যে সমস্ত দেশে রয়েছে সেখানে মিডিয়া স্বাধীনতা পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা ও অগ্রসর করার জন্য বিভিন্ন সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম। এমএফসি জুলাই ২০১৯ সালে গ্লোবাল কনফারেন্স ফর মিডিয়া ফ্রিডম এ প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়। প্রথম ১৫ মাসে গড়ে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরবর্তী ৯ মাসে গড়ে ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর একক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় হিসেবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই বেশি মামলা হয়েছে।
জরিপে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক নেতাুকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, শিক্ষার্থীদের ২ দশমিক ৯১ শতাংশ, শিক্ষক ২ দশমিক ৯১ শতাংশ, বেসরকারি চাকরিজীবী ২ দশমিক ১৮ শতাংশ, ব্যবসায়ী ২ দশমিক ১৮ শতাংশ, সরকারি চাকরিজীবী ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও আইনজীবী শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ।
আর মামলা যারা করেছেন, অর্থাৎ বাদীরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন কোনো সংগঠনের নেতাকর্মী অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আইনটি জারি করার সময় সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছিলেন, ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ দমন করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। তারা যে কথা রাখেননি, এর প্রমা।ণ ওপরের পরিসংখ্যান।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগই অপপ্রয়োগ। এখানে গুণাগুণ বিচারের কোনো সুযোগ নেই। ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি অনুযায়ী নেওয়া যায়। এই আইনের প্রয়োজন নেই।
এখন দেখা যাক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কীভাবে সাংবাদিক তথা নাগরিকদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। এতে বলা হয়, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতিপ্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে দোষী ব্যক্তির ৩ থেকে ৭ বছরের কারাদন্ড, জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।
আইনটির বেশির ভাগ ধারা জামিন অযোগ্য। এ কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কারাগারে থেকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি নিরপরাধ। এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার হয়েছে। বিচার করা এ আইনের প্রধান উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হলো ভয় পাইয়ে দেওয়া। অর্থাৎ এই আইনের মাধ্যমে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ পিছিয়েছে, এটা অস্বাভাবিক নয়। যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে, সেখানে এটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্নার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল আরও নিচে চলে যাবে। যেখানে গণমাধ্যমে কার্টুন ছাপা যায় না, হাস্যকৌতুকমূলক কোনো লেখা প্রকাশ করা যায় না, সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে কীভাবে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করাই হয়েছিল বিরুদ্ধমত স্তব্ধ করে দিতে। আর আইনটি প্রয়োগে পুলিশকে যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইন বহাল থাকতে আমি উন্নতির আশা দেখি না।’
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২২ সালের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম (স্কোর ৩৬ দশমিক ৬৩)। ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম (স্কোর ৫০ দশমিক ২৯)।
আর ২০২০ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১তম। অর্থাৎ, গত দুই বছরের সূচকেও বাংলাদেশের এক ধাপ করে অবনতি হয়েছিল। এবারের সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার ছাড়া সবার নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত (১৫০), পাকিস্তান (১৫৭), শ্রীলঙ্কা (১৪৬), আফগানিস্তান (১৫৬), নেপাল (৭৬), মালদ্বীপ (৮৭), ভুটান (৩৩)।
সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের অবস্থান ১৭৬, গত বছর ছিল ১৪০। এবারের সূচকে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপের অবস্থানেরও অবনতি হয়েছে। ভারত পিছিয়েছে আট ধাপ, পাকিস্তান পিছিয়েছে ১৭ ধাপ, শ্রীলঙ্কা ১৯ ধাপ, আফগানিস্তান পিছিয়েছে ৩৪ ধাপ আর মালদ্বীপ পিছিয়েছে ১৫ ধাপ। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে ভুটানের, ৩২ ধাপ এগিয়েছে দেশটি। আর নেপাল এগিয়েছে ৩০ ধাপ।
এসডব্লিউএসএস/১১০৫
আপনার মতামত জানানঃ