মাহবুব আরিফ কিন্তু
“কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।
আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি॥
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রাষ্ট্র হিসাবে পাক-ভারতকে বিভক্ত করা হয়েছিল। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত – যা ছিলো একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং ইসলামিক প্রজাতন্ত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান। মানব ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ অভিবাসন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, কারণ লক্ষ লক্ষ মুসলমান পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানে (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ হিসাবে পরিচিত) পাড়ি জমান, যখন লক্ষ লক্ষ হিন্দু এবং শিখ বিপরীত দিকে যাত্রা করেছিল একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে।
আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও মনের মাঝে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়; ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর যে সকল মুমিন ভাইয়েরা ও তাদের প্রজন্ম একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে চলে আসেন, তারা কি আদৌ ১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মনে থেকে গ্রহণ করে ছিলেন? অনেকেই তা পারেন নাই। কারণ হঠাৎ করেই মুসলিম প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে – ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে চলে আসা ধার্মিক মুসলমান ভাইদের মাথায় সেটা ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটি ঘটনা। ছলেবলে কৌশলে এই মুসলমান ধার্মিক সম্প্রদায় আজ ক্ষমতার অনেক অনেক উপরে চলে গিয়ে আজও বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র তৈরির স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।
ভারত উপমহাদেশ জুড়ে প্রায় হাজার বছর সহবস্থানে থাকা সম্প্রদায়গুলি একদিকে হিন্দু ও শিখ এবং অন্যদিকে মুসলমানদের সাথে একত্রিত হয়ে থাকতে না পেরে এক ভয়াবহ সংঘাত ও ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত হয়েছিল। পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায় পারস্পরিক গণহত্যা যেমন অপ্রত্যাশিত ছিল, ততটাই অপ্রত্যাশিত ছিল বাংলার বিভক্তি। পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমানা প্রদেশগুলিতে গণহত্যার ঘটনা, অগ্নিসংযোগ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, গণ অপহরণ এবং বর্বর যৌন সহিংসতা সহকারে এইসব হত্যাকাণ্ড এতটাই তীব্র ছিল যে নিষিদ হাজারি তাঁর “মিডনাইটের ফিউরিস” (হাউটন মিফলিন হারকোর্ট) বইতে তার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “প্রায় পঁচাত্তর হাজার মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং সেই অপকর্মের অনেক নেতা বা রাজনৈতিক কর্মী অনেককেই তখন ছদ্মবেশ দুই বাংলাতেই দাপটের সাথে এইসব অপকর্মে লিপ্ত ছিলো। তিনি আরও লিখেছিলেন “খুনিদের দল গোটা গ্রামগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেছিল, পুরুষ, শিশু এবং বৃদ্ধদের বুকে ও গলায় চাকু চালিয়ে হত্যা করেছিল, যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছিল।” কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে ও পূর্ব বাংলায় এই তাণ্ডবের ইতিহাস জানতে হলে পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছিল তা স্বয়ং নেতা করম চাঁদ গান্ধীর পক্ষেও সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। কিছু ব্রিটিশ সেনা এবং সাংবাদিক যারা এই নাৎসি মৃত্যু শিবিরের সাক্ষী ছিল তাদের দাবি ছিল যে দেশভাগের বর্বরতা এতটাই খারাপ ছিল যে দুই বাংলাতেই গর্ভবতী মহিলাদের স্তন কেটে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের পেটে বাচ্চা কেটে ফেলা রাস্তার উপর ফেলে রাখা হয়েছিল”।
১৯৪৮ সালের মধ্যে মহা অভিবাসন যখন নিকটে পৌঁছে ছিল, পনের মিলিয়নেরও বেশি লোক এপার ওপার বাংলায় পাড়ি জমিয়েছিল। এক থেকে দুই মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। মৃত্যু শিবিরগুলির সাথে তুলনা এতটা সুদূরপ্রসারী যা বর্ণনা করা সম্ভব ছিলনা। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বর্বরতা ছিলো একটি ইতিহাস। হলোকাস্ট ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার ও অকল্পনীয় সহিংসতার স্মৃতি আমরা জানি এই উপমহাদেশের আঞ্চলিক সহিংসতা ছিলো ঠিক সে রকম একটি বেদনাদায়ক ইতিহাস। প্রশংসিত পাকিস্তানি ইতিহাস বিশারদ আয়েশা জালাল দেশভাগকে “বিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রীয় ঐতিহাসিক বর্বর ঘটনা বলে অভিহিত করে তিনি লিখেছেন, “একটি সংঘটিত মুহূর্ত যা শুরু হয়েছিল কিন্তু শেষ ছিলনা। বিভাজন উত্তরোত্তর দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ এবং রাষ্ট্রগুলি কীভাবে তাদের অতীত থেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কল্পনা করে তা প্রভাবিত করবে তা তার জানা নাই।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেনের পক্ষে সাম্রাজ্য সম্পদ নিয়ন্ত্রণ ও এর সংস্থান করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ভারত থেকে ব্রিটিশদের প্রস্থান ছিল একটি একটি সুনিশ্চিত পরিকল্পিত ঘটনা। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে আমাদের এই প্রস্থান উপমহাদেশে নিয়ে এসেছিল একটি অস্থিতিশীল ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক পরিবেশ। পশ্চাদাপসরণকারী উপনিবেশকারীদের সুবিধার দিক থেকে যদিও এটি একটি মোটামুটি সফল প্রস্থান কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে রেখে গেল ধর্মীয় সংঘাতের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে দীর্ঘদিন ধরে সহিংস বিদ্রোহ ও নৃশংস দমন দ্বারা চিহ্নিত ছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সবেমাত্র গুলি চালানো এবং মাত্র সাতজন হতাহতের মাধ্যমে তারা দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। একইভাবে অপ্রত্যাশিত ছিল আগত রক্তপাতের বৌদ্ধিকতা।
বিংশ শতাব্দীর মাত্র কয়েক দশক ধরে হিন্দু ও মুসলমানদের মেরুকরণ ঘটেছিল। তবে শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এটি এতটাই ভয়াবহ হয়েছিল যে উভয় পক্ষের অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন যে দুটি ধর্মের অনুসারীদের পক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করা অসম্ভব। সাম্প্রতিক কালে একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে সত্তর বছরের জাতীয়তাবাদী পৌরাণিক কাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। দেশ ভাগের মৌখিক স্মৃতিগুলি রেকর্ড করার বিস্তৃত প্রচেষ্টা হয়েছিল বটে কিন্তু দুই বাংলার ধর্মান্ধ উন্মাদদের আস্ফালনে এই প্রজন্মের মানুষদের জন্যে সেই দিনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিটিকে কবর দেয়া হয়েছে।
অবশেষে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় পঞ্চমাংশ জনসংখ্যার মানুষ নিজেদের মুসলিম হিসাবে চিহ্নিত করে এসেছিল। ইসলামের প্রসারের সাথে যুক্ত সূফী রহস্যবাদীরা প্রায়শই হিন্দু ধর্মগ্রন্থকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। বাংলাদেশে হিন্দুদের পূজা পার্বণকে মুসলিম সম্প্রদায় মুখে না বলুক অন্তর থেকেই ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে। কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই হাইব্রিড ইন্দো-ইসলামিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে।শংকর ভাষাগুলির সাথে বিশেষত ডেকানি এবং উর্দু (যা তুর্কী), ফারসি এবং আরবি শব্দের সাথে ভারতের সংস্কৃত উদ্ভূত স্থানীয় ভাষার মিশ্রণ শুরু হয়। আর এই ধর্মান্ধ বৃহদাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের আগমন ঘটেছিল ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালে। কাজেই তাদের ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ ও তার সংবিধানকে গ্রহণ করা কখনই সম্ভব হবে না। এইসব অভিবাসিত মুসলিম ধার্মিকগন সুযোগ পেলেই যে কোনও জায়গাতেই তাবলীগ বা জিহাদ শুরু করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানটি আজও গেয়ে যাই-
“কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।
আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি॥
ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে,
কত বসন্তে দখিনসমীরে ভরেছে আমারি সাজি॥
নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,
বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।
মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার–
সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি॥
আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি॥
ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে,
কত বসন্তে দখিনসমীরে ভরেছে আমারি সাজি॥
নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,
বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।
মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার–
সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি॥
এখন আমাদের হিসাব নিকাশের সময়- “কি হারিয়েছি আর কি পেয়েছি।”
আপনার মতামত জানানঃ