সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে দল বেঁধে ধর্ষণের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ জোরালো হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও জড়িত। যে কারণে প্রতিবাদ করতেও ভয় পায় ভুক্তভোগীরা। এদিকে গত সাত বছরে ধর্ষণের ঘটনায় ঢাকাসহ দেশে অন্তত ৩৪ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সারা দেশে ৯৫টি ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীনে অন্যান্য মামলার বিচার হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ মামলায় সাক্ষীদের খোঁজ পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে সাক্ষী সুরক্ষা আইনের খসড়াটি। কবে খসড়া চূড়ান্ত হবে তা কেউ পরিষ্কার করে বলতে পারছে না। এছাড়া সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে হাইকোর্টের একাধিক নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মীদের মতে, মামলার ত্রুটিযুক্ত তদন্ত ও অভিযোগপত্র, তারিখের পর তারিখ সাক্ষীর গরহাজিরা, সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ (৪) ধারায় ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ আখ্যা দেওয়ার সুযোগ, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়া, সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকা, অনেক ক্ষেত্রে আসামিপক্ষের সঙ্গে বাদীপক্ষের আপস বিচারে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
এসব ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল মঙ্গলবার তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, নোয়াখালীতে নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্বরতার চরমসীমা। এটা জঘন্য অপরাধ। আইন অনুযায়ী অপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। অপরাধীরা যেন কোনোভাবে ছাড় না পায় সেজন্য নির্ভুল তদন্ত রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশে বিচারহীনতার কোনো সংস্কৃতি নেই দাবি করে তিনি বলেন, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চুপচাপ বসে নেই। একের পর এক অপরাধী ধরা হচ্ছে এবং বিচার হচ্ছে। নোয়াখালীর ঘটনায় দুজন বাদে সবাইকে ধরে ফেলেছি। এখানে কোনো রকমের গাফিলতি নিরাপত্তা বাহিনী দেখায়নি। শিগগিরই তাদের আইনের মুখোমুখি করব।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ধর্ষণের এখন যে পরিস্থিতি তাতে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিশ্চয়ই সম্মানজনক হবে না। এজন্য বিচার নিষ্পত্তি ও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা পরিহার করতে হবে। মামলার তদন্ত শেষ করে ত্বরিতগতিতে এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। ধর্ষণের মামলা বিচারে দীর্ঘসূত্রিতার কারণ ঘন ঘন শুনানি মুলতবি করা। এভাবে বছরের পর বছর সময় পার হয়ে যায়। এতে করে সাক্ষী হারিয়ে যায়। ভুক্তভোগীরাও হতাশ হন। তিনি আরও বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হবে এবং বিচার একবার শুরু হলে খুব জরুরি কারণ ছাড়া শুনানি মুলতবির আবেদন গ্রাহ্য করা যাবে না। একনাগাড়ে বিচার শুরু হবে এবং তা শেষ করতে হবে। যদি এটি করা যায় তাহলেই বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে এবং একটি মামলা নিষ্পত্তি হলে অন্য একটি মামলা নিষ্পত্তির পথ তৈরি হবে। সাক্ষী সুরক্ষা আইন তৈরির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ফৌজদারি আইনের মামলায় সাক্ষীর সুরক্ষা না থাকলে সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসবেন কেন? যতদূর জানি সাক্ষী সুরক্ষা আইনের খসড়াটি এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সাক্ষী সুরক্ষা আইন কেন হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়। এটি অত্যন্ত জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকহারে। বিশেষ করে সিলেট ও নোয়াখালীতে ধর্ষণের ঘটনায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গত ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ জন। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬৮ নারী। যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ১২ নারী। এ সময়ের মধ্যে ১১ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হন এবং ৩২ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ এবং আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। এছাড়া ৬২৭ শিশু ধর্ষণ ও ২০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে বলে আসক জানিয়েছে। তারা আরও জানিয়েছে, পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ সময়কালের মধ্যে সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা, বিশেষত ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়ন ও পারিবারিক নির্যাতনের সংখ্যা এবং ঘটনার ধরনে ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরে অন্তত ৩৪ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, এগুলো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটা আমরা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছি। আমরা চাই এসব অপরাধীকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এটাকে ঘৃণা করছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। তবে এই মুহূর্তে যদি অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি না দেওয়া হয় তবে মানুষ আইনের প্রতি হতাশ হয়ে পড়বে। অপরাধীরা যেন কোনোভাবে মুক্তি না পায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, ধর্ষণকারীদের বিচারের আওতায় এনে তাদের শাস্তি দৃশ্যমান হলে অপরাধীদের মনে ভয়ের সঞ্চার হবে। আর ওই ভয়ের কারণে ধর্ষণকারীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস পাবে না। এতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের আদালতগুলো এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। এছাড়া আদালতে অবকাঠামোর যে সংকট তাতে ধর্ষণের হাজার হাজার মামলা নিষ্পত্তির সম্ভাবনার অনিশ্চয়তা রয়েই যাচ্ছে। সার্বিকভাবে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তির যে চিত্র তাতে আমরা অনেক দিন থেকেই হতাশ। তিনি আরও বলেন, ‘সাক্ষীর গরহাজিরার কারণে ধর্ষণ মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ে। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন ভুক্তভোগীর বিচার পেতে চারজন পুলিশের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা। কিন্তু গত এক বছরে একজন সাক্ষীও হাজির করা যায়নি। যেখানে পুলিশই সাক্ষ্য দিতে আসে না সেখানে বিরূপ পরিস্থিতিতে সাধারণ সাক্ষীরা কেন আদালতে আসবে? তিনি বলেন, বিচার দ্রুত নিষ্পত্তিতে সাক্ষীর সুরক্ষা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। তাই সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সাক্ষীকে হাজিরা করা খুবই দুরূহ। রাষ্ট্রকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।
ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক কৌঁসুলির বক্তব্য এবং বেশকিছু মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোনো ধর্ষণের মামলা আদালতে গড়ালে সেটি কমপক্ষে পাঁচ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির নজির খুব একটা নেই। আইনের বিধান মতে, এ ধরনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হয়। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়, নির্দেশনামূলক। ১০ থেকে ১২ জন সাক্ষীর মধ্যে তিন থেকে পাঁচজন সাক্ষী হাজির করতে কয়েক বছর পার হওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে। নাবালিকা শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ সংকট আরও বেশি। একটা সময়ে ভুক্তভোগী ও তার পরিবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ঘটনা ভুলে নতুন করে জীবন শুরুর চেষ্টা করে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ধর্ষণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বেশকিছু নির্দেশনা ও অভিমত দেয়। ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়ের (১৮০ দিন) মধ্যে নিষ্পত্তি করতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা, শুনানি ও সাক্ষ্য শুরু হলে প্রতিটি কর্মদিবসে টানা শুনানি, ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ রাষ্ট্রপক্ষ সংগত কারণ ছাড়া সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট তদারকি কমিটিকে জবাবদিহির আওতায় আনা, সমন পেলে ধার্য তারিখে অফিশিয়াল সাক্ষী (ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, চিকিৎসক) বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সাক্ষী উপস্থিত না হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে তাদের বেতন বন্ধের আদেশ প্রদান বিবেচনার কথা বলা হয়। সরকার অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করবে বলে আদালত অভিমত ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করে। তবে হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাক্ষী সুরক্ষা আইন তৈরির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশমালা পাঠায় আইন কমিশন। সেখানে সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও অধিকার, তাদের অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সাক্ষীর অঙ্গীকারসহ অন্তত ১৯টি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয় আইনের একটি খসড়া প্রস্তুত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সুরক্ষা আইনের খসড়াটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ