জানা যায়, চরম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল পম্পেই শহর। বছরে বেশ কয়েকবার মাঝারি আকারের ভুমিকম্প শহরটির নিয়মিত দৃশ্যই ছিল। তাই ভূমিকম্প নিয়ে এখানকার মানুষের তেমন কোনো আতঙ্ক কাজ করতো না। ইতিহাসবিদদের মতে, ৬২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বড় ধরণের ভূমিকম্পের মুখে পড়ে পুরো ইতালি। আর এই ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় সুদর্শন নগরী পম্পেই। ভয়ংকর সেই ভূকম্পনের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ৫ থেকে ৬-এর মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিল বলে জানান প্রত্নতাত্ত্বিকরা। অন্যদিকে, একইদিনে পম্পেইয়ের জাতীয় দিবস থাকায় সেদিন নগরীর রাস্তায় রাস্তায় বসেছিল উৎসবের মেলা। উৎসবের সময় এমন ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়তে থাকে নগরীর বড় বড় সকল স্থাপনা। আর উৎসবে ব্যবহারকৃত আতশবাজি এবং তেলের বাতির বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের কারণে সেখানে বেশ কিছু বিস্ফোরণও ঘটে, যা ক্ষতির পরিমাণ আরও চারগুণ বাড়িয়ে দেয়।
ভূমিকম্পের ক্ষতি কাটিয়ে তখনও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি পম্পেইয়ের মানুষজন। প্রায় ১৬ বছর পর নেপলসের কাছে অবস্থিত আগ্নেয়গিরিতে শুরু হয় ছোটখাটো অগ্ন্যুৎপাত। ধর্মভিরু পম্পেইবাসী নিজেদের রক্ষা করতে আগুনের দেবতার কাছে হাত পাতে। ভাল্কানালিয়ার পূজা দিয়ে বড় উৎসবের আয়োজন করলেও ভাগ্য সহায় হয়নি। পূজার পরদিনই আগ্নেয়গিরির চূড়ান্ত অগ্ন্যুৎপাত ধ্বংস হয়ে যায় ভিসুভিয়াস কন্যা পম্পেই। ধারণা করা হয় ৭৯ সালের ২৪ আগস্ট ধ্বংস হয় ১৬০-১৭০ হেক্টরের পম্পেই নগরী। চাপা পড়ে সেখানে বাস করা প্রতিটি জীবকুল। আজ পর্যন্ত এই নগরী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১১৫০টি প্রস্তরীভূত কঙ্কাল। কঙ্কালগুলোকে দেখে ধারণা পাওয়া যায়, আচমকা সেই বিপর্যয়ে পালানোর সুযোগ পায়নি তারা। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই নগরীতে মানুষের সাথে মিলেছে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর প্রাচীন রোমান মুদ্রাও।
৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ধ্বংস হয় পম্পেই নগরী। কিন্তু সেই নগরী আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছে সেই সময়ের একটি স্থির মুহূর্ত যার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় ধ্বংসের ঠিক আগের মুহূর্তেই সমগ্র পম্পেই মুখর ছিল জীবনের কলরোলে, আর ঠিক পরের মুহূর্তেই যেন সেই কলরোল থেমে যায় মৃত্যুর নিরবতায়।
এই অগ্ন্যুৎপাত আমাদের দিয়ে গেছে এই পম্পেই নগরীর দৈনন্দিন জীবনের কিছু স্থির চিত্র। যেগুলোকে দেখে আমরা যেন এক নিমেষে চলে যাই আজ থেকে ১ হাজার ৯৩৮ বছর পূর্বের ৭৯ খ্রিষ্টাব্দের পম্পেই নগরীতে। হ্যাঁ, এই পম্পেই এর ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় ১,৫০০ জন মানুষের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে যাদের কাঠামো এখনও ঠিক সেভাবেই আছে যেমনটা ছিল মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে।
এদের কোন কোনটা সাংঘাতিক হৃদয়স্পর্শী। তাদের কেউ কেউ সময় কাটাচ্ছিলেন পরিবারের সাথে, দুজনকে দেখা গেছে মৃত্যুর সময় আলিঙ্গনরত অবস্থায়।
এখানে, প্রায় দু’হাজার বছর পরও মৃতদের মৃত্যুর সময়কার শারীরিক কাঠামোর এভাবে অবিকৃত থাকার কারণটা ব্যাখ্যা করা উচিৎ। এরা আগ্নেয়গিরির পাইরোক্লাস্টিক সার্জের ফলে আকষ্মিকভাবে মারা যায়। এরপরই আগ্নেয়গিরির ছাই এদের উপর এসে পড়ে, অর্থাৎ এরা ছাই এর নিচে চলে যায়। কিন্তু এরা অবিকল থাকে কারণ এই ছাই পরে শক্ত হয়ে পোরাস বা ছিদ্রযুক্ত পাথরে পরিণত হয় যা পিউমিস নামে পরিচিত। মৃতদেহের উপরে ছিদ্রযুক্ত শেল থাকায় এর ছিদ্রগুলোর মধ্য দিয়ে শরীরের ভেতরের নরম অংশগুলো গলে আস্তে আস্তে ছিদ্রগুলো দিয়ে বের হয়ে যায়, বিনিময়ে সেই শেল শরীরের অবয়ব ধারণ করে নেয়।
যাই হোক এদের একটি ছবি এখন বিশেষভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল মানুষের মধ্যে। আর সেটা হল একজন সাম্ভাব্য হস্তমৈথুনরত মানুষের ধ্বংসাবশেষ। লোকটি “মাস্টারবেটিং ম্যান” নামে এখন যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছেন।
ছবিটিতে আসলে দেখা যাচ্ছে, লোকটি তার ক্রাউচ রেজিয়নের উপরে ধরে আছেন। আসলে তিনি কি করছেন তা বোঝা যাচ্ছে না, হয়তো কখনই আমরা নিশ্চিত হতে পারব না। কিন্তু খুব সম্ভব যা ভাবা হচ্ছে তিনি তাই করছিলেন।
সে যাই হোক, এখানে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ রয়েছে। পম্পেই এর ভিক্টিমরা কিভাবে মারা গিয়েছিল তা নিয়ে কিছু থিওরি আছে। সেগুলো অনুসারে লোকগুলো আকষ্মিকভাবেই উষ্ণ গ্যাসের বিষ্ফোরণে মারা যায়, যা তারা কখনই বুঝে উঠতে পারেনি। ২০০১ সালের একটি গবেষণায় ভষ্ম থেকে ৮০টি দেহাবশেষ তুলে পরীক্ষা করা হয় যেগুলো এরকম কঠিন হয়ে গিয়েছিল। এগুলো থেকে এমন কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি যা দেখে মনে হয় যে তারা মৃত্যুর পূর্বে কোনরকম ব্যাথা অনুভূত করেছিল।
নেপলস দ্বিতীয় ফেডেরিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ আলবার্টো ইনকরোনাতো জানান, “এদের মধ্যে আত্মরক্ষামূলক কোনরকম ইচ্ছাকৃত প্রতিক্রিয়া বা দুঃখের চিহ্ন দেখা যায় নি, যা থেকে বোঝা যায় সচেতন প্রতিক্রিয়া তৈরির জন্য এদের কাছে খুব কম সময়ই ছিল। এর ফলে শহরের খুব কমই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, কিন্তু এই লোকগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিল।”
পম্পেইতে যারা উষ্ণ গ্যাসের বিষ্ফোরণে মারা যায়নি, তারা দালানের ভেঙ্গে পড়ার ফলে বা ছাইয়ের কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। কিন্তু এই “মাস্টারবেটিং ম্যান” এর আশেপাশে সেরকম কোন ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় নি। সুতরাং ধরে নেয় যায়, এই লোকটি সেই সব ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি আকষ্মিকভাবেই মারা, আর আসন্ন মৃত্যুর ব্যাপারে কোন ধারণাই তার ছিল না। হস্তমৈথুন করতে করতে ব্যাথাহীন মৃত্যু হয়েছিল তার।
এসডব্লিউএসএস/১০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ