বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি বেশি সার্কুলার দিচ্ছে। এসব সার্কুলার বারবার সংশোধন করতে হচ্ছে। এর ফলে গ্রাহকরা সংশয়ে পড়ছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। করোনায় ব্যাংক খাতের করণীয় নিয়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথম প্রান্তিকে আয়োজিত এক অনলাইন বৈঠকে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি সার্কুলার দিচ্ছে। এত সার্কুলার আমার সময়ে ছিল না। যত কমসংখ্যক সার্কুলার দেয়া যায়, তত ভালো। কিন্তু প্রতিদিন ৫-১০টি সার্কুলার দিয়ে ব্যাংকার ও গ্রাহকদের সংশয়ে ফেলা যাবে না। একটি সার্কুলার দিয়ে তিন-চার বার তিন-চার লাইন সংশোধন করার কোনো মানে হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুচিন্তিত সার্কুলার দেয়া দরকার।’
বর্তমান পরিস্থিতির বিশেষত্ব নিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোভিডের আগেই আমাদের কিছু সমস্যা ছিল। সেগুলো হঠাৎ করেই আমরা কার্পেটের নিচে চাপা দিতে পারব না। কভিড আসার ফলে সেসব সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। আর নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। চ্যালেঞ্জগুলো বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকে। বৈশ্বিকভাবে চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতিগুলো ধীর হয়ে যাচ্ছে, আমাদের রফতানি আদেশ বাতিল হচ্ছে, স্থগিত হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি তেমন হচ্ছে না বা মূলধনি যন্ত্রপাতি আসছে না। রাজস্ব আদায় কমে যাচ্ছে। আবার রিজার্ভ বাড়ছে। এ ধরনের কিছু প্রভাব আছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বড় ইস্যু হলো ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ। এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এতে সুচিন্তিতভাবে প্রায় সব খাতই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যাংকনির্ভর ও ঋণনির্ভর। সুতরাং দক্ষতার সঙ্গে এটি ব্যবস্থাপনা সম্ভব না হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। এখন পর্যন্ত প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। কারণ ব্যাংকগুলো বর্তমানে যা করছে তা রুটিন কাজ। এটা বিশেষ সময়ের বিশেষ দায়িত্ব। দ্রুততা ও সাবধানতা, এখন কাজের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে।’
সমস্যার কারণ খুঁজে বের করার ওপর জোরারোপ করে সালেহউদ্দিন বলেন, ‘অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে হলে ব্যাংক খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঝুঁকি থাকবে, নানা সমস্যা থাকবে, এর মধ্যেই কাজ করতে হবে। একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ থাকবে, সেটি প্রত্যাশা করলে হবে না। খেলাপি ঋণ বেশি, ক্যাপিটাল অ্যাডেকোয়েসি বেশি ইত্যাদি সমস্যার কথা বলছি, কিন্তু এর আসল কারণগুলো খুঁজছি না। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখব সুশাসন, জবাবদিহিতা ও ভালো নীতির অভাব, প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি, সেবা দেয়ার মানসিকতার অভাব এবং ব্যাংকারদের মধ্যে লাভের প্রতি অতি ঝোঁক। এসব সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো কঠোর হতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কোভিডের সময়ে রফতানি খাতে, রেমিট্যান্সে আলোর ঝলক দেখতে পেয়েছি। তবে তৈরি পোশাক খাত যে আরো উন্নত হবে, তার লক্ষণ নেই। এখন প্রতিযোগিতা আরো বেশি। রফতানি বহুমুখিতা বাড়ানো না গেলে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। আর পোশাক খাত সুবিধা চাইতেই থাকবে। দেশের রফতানি আয়ের উৎসকে বহুমুখী করতে হবে, নইলে একক নির্ভরতা টেকসই হবে না।’
১০ ডিসেম্বর ২০২০ আয়োজিত ওই ওয়েবিনারে সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলো আমাদের রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। এগুলো নিঃসন্দেহে সম্প্রসারণমূলক হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে হবে। আমরা এখনো সত্যিকার অর্থে সব জনগণকে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। এটি করতে হবে। ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির ‘হিরো’। তারা নিয়মিতভাবে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। তাদের জন্য সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটুকু করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর মনে করেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা শক্ত অবস্থান নিতে হবে। ব্যাংকাররা অনুশাসন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত হাতে অনুশাসনগুলোর পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।’
এসডাব্লিউ/বিবি/আরা/১১৩০
আপনার মতামত জানানঃ