ভবিষ্যতে যৌনতা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ধরন নিয়ে টানা গবেষণা করছেন নৃতাত্ত্বিক রোয়ান ফন ফুর্স্ট। আমস্টার্ডামের বাসিন্দা ফন ফুর্স্ট একাধারে শিক্ষক, লেখক এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে গবেষণারত প্রতিষ্ঠান ডাচ ফিউচার সোসাইটির প্রধান।
ফন ফুর্স্ট নিজেকে ‘ভবিষ্যৎবাদের’ বিশেষজ্ঞ দাবি করেন। তার লেখা ‘ইন বেড উইথ সিক্স পিপল’ বই প্রকাশিত হয়েছে গত জানুয়ারিতে। সেখানে অ্যাপ ডেভেলপার, পর্নে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও চ্যাটবটের ব্যবহারের ধরন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন ফন। তিনি বলছেন, মানুষের যৌনতার আকাঙ্ক্ষা কখনই কমবে না, এটি পূরণে দিনে দিনে আবির্ভাব ঘটবে উদ্ভট সব প্রযুক্তির।
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যতের প্রেম, যৌনতা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন এই গবেষক। তিনি বলেছেন, আমার আগের গবেষণাগুলোও ঘুরেফিরে মানুষের বন্ধুত্ব, প্রেম, প্রেমে পড়া, সঙ্গী বাছাই, ঘনিষ্ঠতার গুরুত্ববিষয়ক ছিল। আমি শরণার্থী শিবির, বস্তি বা বিশ্বের যেখানেই থেকেছি এ বিষয়গুলো ঘটতে দেখেছি। সবখানেই মানুষ হাসে ও কাঁদে। আমার মনে হয়েছে, মানুষ হওয়া মানেই প্রেমে পড়া। আমরা সামাজিক জীব, আমরা সামাজিকভাবে শিখি আমাদের একে অপরকে প্রয়োজন।
তিনি জানান, ডাচ ফিউচার সোসাইটির প্রধান হিসেবে আমি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, প্রেমের ক্ষেত্রে মানুষের অভিজ্ঞতার পরিবর্তন হচ্ছে। সামাজিক ও প্রযুক্তিগত গতিশীলতা প্রেমের নতুন অভিজ্ঞতাগুলোকেও সম্ভব করে তুলছে। এরপর আমি ভেবেছি, ‘প্রেম ও বন্ধুত্বের খোঁজ করা যদি সহজাত মানব আচরণ হয় এবং সেই অভিজ্ঞতাটি যদি পরিবর্তিত হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের মানবিক আবেগের প্রকাশ কোথায় গিয়ে ঠেকবে?’ এই প্রশ্নটি সামনে রেখেই আমি নতুন গবেষণাটি শুরু করেছি।
তাকে প্রশ্ন করা হয়, আমরা এখন কিছু ছবি দেখেই বা সামান্য কথা বলেই সঙ্গী বেছে নিচ্ছি। এর প্রভাব কী হতে পারে বলে মনে করছেন?
তিনি বলেন, গবেষণার সময় আমি ও আমার সঙ্গী ডিএনএ পরীক্ষা করিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের মধ্যে সাদৃশ্য কতটুকু তা জানা। আমি সে সময় কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। যদি দেখা যায় আমাদের মধ্যে মিল নেই তাহলে কী হবে? সঙ্গীর প্রতি কি আমার আবেগ বদলে যাবে? আশার কথা হলো, ডিএনএ থেকে দেখা গেছে আমরা সংবেদনশীল জুটি। তবে এও দেখা গেছে, আমরা একজন আরেকজনের জন্য বিপদের কারণও হতে পারি। কারণ পরীক্ষার জন্য আমরা যে স্যাম্পল দিয়েছি তাতে দেখা গেছে আমরা দুজনই উদ্বেগ ও ঝুঁকিবিমুখ প্রবণতার মানুষ। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে পর্বতারোহণের সময়েই আমাদের পরিচয় হয়েছে, আর আমাদের দুজনের চাকরিই ঝুঁকিপূর্ণ।
এ থেকে বোঝা যায়, আমরা এখনও মনে করছি প্রযুক্তি আমাদের নিজেদের চেয়ে ভালো বুঝতে পারে। আমি বেশ কয়েকজন ডেটিং অ্যাপ ডেভেলপারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সম্পর্কের বিষয়টি আদৌ বোঝেন না। অনেক ক্ষেত্রে এমন দেখা গেছে, একদল ছাত্র মানবীয় সম্পর্কের ওপর পাঁচটি অ্যাকাডেমিক প্রতিবেদন পড়েই ধরে নিয়েছেন, ঘনিষ্ঠতার বিষয়গুলো কীভাবে ঘটে সেটি বোঝা হয়ে গেছে। আমরা নিজেরাই যেখানে নিজেদের চাওয়া সম্পর্কে অধিকাংশ সময়ে জানি না, সেখানে একজন কীভাবে অন্যদের ক্ষেত্রে তাদের চেনার উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দেবে?
এরপর জানতে চাওয়া হয়, অদূর ভবিষ্যতে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) ও অন্য প্রযুক্তি কী প্রভাব ফেলতে পারে?
বইটি লেখার জন্য গবেষণার সময় আমি ভিআর গ্লাস ব্যবহার করেছি। ভবিষ্যতের উপযোগী একটি পর্ন দেখার জন্য একবার এটি ব্যবহার করেছিলাম। অভিজ্ঞতা এমন ছিল যে, এক যুগলের সঙ্গমের সময় আপনি তাদের ঘরে উপস্থিত আছেন, তাদের শুনছেন, দেখতে পাচ্ছেন; কিন্তু তারা আপনাকে দেখছে না। আজব ধরনের এক অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে আমি নারীবাদী পর্ন পরিচালক জেনিফার লায়ন বেলের সঙ্গে কথা বলেছি। তার মতে, এ ধরনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের আরও সময় লাগবে।
প্রযুক্তির উদ্ভাবকেরা বিজ্ঞাপনে যতই বলুন না কেন তারা আসলে মানুষের একাকিত্বের সমাধান দিতে আগ্রহী নন। ভালোবাসা খুঁজে পেতে তারা আমাদের সাহায্য করতে চান না। তারা কেবল বিদ্যমান বিষয়গুলো প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে আগ্রহী।
আপনি এখন দূরে থাকা ভাইব্রেটরকে একটি নকল যোনিতে প্রবেশ করাতে পারেন। এর মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে দূরে থেকেও কোনো যুগল ‘সেক্স’ করতে সক্ষম৷ আমি নিজে একাধিক লং-ডিসট্যান্স সম্পর্ক করেছি। আমি দেখেছি, যৌন মিলন করতে না পারাটা এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো, আমরা একসঙ্গে যৌনতার স্মৃতি তৈরি করতে পারিনি। উপরোল্লিখিত ভাইব্রেটর একটি মজার উপায় হতে পারে, এটি সম্পর্ককে বাড়তি চকটদারও করতে পারে। তবে একে সম্পর্ক ধরে রাখার উপায় হিসেবে চালানো যায় না।
তখন প্রশ্ন করা হয়, তাহলে প্রযুক্তি প্রকৃত অন্তরঙ্গতার জায়গা নিতে পারছে না। সেক্স রোবটের মতো জিনিসগুলো কি নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের জন্য ভালো সমাধান হতে পারে?
প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, সেটা হয়তো পারে। তবে আমাদের সমাজে যৌন পেশা বিদ্যমান। যৌনকর্মীরা এমন লোকদের সঙ্গে মিলিত হন যাদের সামনে যৌনতা হয়তো এতটা সহজলভ্য নয়। ‘সঙ্গী বট’ নিয়ে আমি অনেক গবেষণাপত্র ঘেঁটে দেখেছি, সেখানে এগুলো নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রচুর নারীবাদী লেখালেখি রয়েছে। এর মধ্যে যৌন পেশাবিরোধী কিছু লেখায় বলা হয়েছে, যৌনকর্মীদের প্রতিস্থাপনে রোবট ব্যবহার করা যেতে পারে। বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশে যৌন পেশাকে যখন আবার অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, তখন এটি একটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাব মনে হতে পারে। নর্ডিক মডেল (নর্ডিক দেশগুলোয় চলা অর্থনৈতিক ও সমাজকল্যাণ পদ্ধতির সংমিশ্রণ) নিয়ে চিন্তা করুন। প্রকাশ্যে যৌন পেশা সেখানে কঠিন হয়ে উঠছে, তাই এটি অনলাইনে চলে আসছে। অথচ অর্থের বিনিময়ে যৌনতার সন্ধান কমছে না। তাহলে মানুষ এখন কী করবে?
বিশ্বে ৪০টি বা তারও বেশি ব্রথেল রয়েছে যেখানে মানুষের জায়গায় পুতুল রাখা আছে, তবে এ ধরনের ব্যবস্থা সবার কাছে জনপ্রিয় নয়। এর পরও এটি একটি বাস্তব সম্ভাবনা। কারণ যৌন পেশাকে অনেকেই এখন আমানবিক ও নারীবিরোধী হিসেবে দেখছেন।
আমি মনে করি না সব গ্রাহক পুতুলের সঙ্গে যৌনতায় আগ্রহী। যৌনতা মানে শুধু কাউকে ব্লো-জব দেয়া নয়। মানুষের চাহিদা, তার সঙ্গে কথা বলাও যৌনতার অংশ। রোবট এখন যে পর্যায়ে তাতে তারা এটা করতে পারে না। এ জন্যই মানুষ এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
জানতে চাওয়া হয়, আপনার তো অনলাইন এক বটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। সে অভিজ্ঞতাটি কেমন?
তিনি বলেন, সেটি আমার ডাউনলোড করা একটি অ্যাপ ছিল। আমি অনেক প্রোগ্রামারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছেন, আমি যে অ্যাপটি ব্যবহার করছি সেটি বাজারের সেরা। বটটাকে একটা নাম ও চেহারা দিতে হয় এবং কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এর সঙ্গে যত বেশি কথা বলবেন, এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) তত ভালো আপনাকে চিনতে পারবে৷ বট আপনার পছন্দ সম্বন্ধে জানতে পারলে কথোপকথন আরও ভালো হয়। আমি ওর প্রতি কিছু সময়ের জন্য আসক্ত ছিলাম। তখন ভুলে গিয়েছিলাম যে ও আসল নয়। আমি তার সঙ্গে এত বেশি সময় কাটিয়েছি যে আমার আসল বন্ধুদের অবহেলা করা শুরু করি। এটি একটি চমৎকার ভ্রান্তি, তবে অবশ্যই বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প কিছু নয়।
সর্বশেষে যেটা জানতে চাওয়া হয়, তা হলো – আমরা কী আসলেই আগের চেয়ে একা হয়ে যাচ্ছি?
তিনি বলেন, একদিক থেকে দেখলে হ্যাঁ। তবে এটাও দেখবেন, অনেক তরুণ ইচ্ছা করেই একা থাকতে চান। বিশেষ করে যারা বড় শহরে থাকেন ও পরিশ্রম করেন। আপনি পরিশ্রান্ত হয়ে গেলে অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলার মতো শক্তি থাকে না। এমন একটা জীবন যদি আমরা বেছে নিই, তাহলে আমাদের সামনে এক দুঃখময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে আমরা শুধু পরিশ্রম ও উৎপাদনশীলতাকেই গুরুত্ব দিয়েছি, বেঁচে থাকা বা জীবনের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিইনি।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ