সংগঠন ও সভা–সমাবেশের অধিকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। বিএনপির প্রতি বৈষম্য করে এবং বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাসীন দল বা সরকার কতটা লাভবান হচ্ছে বা আদৌ হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর তারাই ভালো দিতে পারবে। তবে বিএনপির সমাবেশে নানা ধরনের বাধা ও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করায় ঝিমিয়ে পড়া দলটি যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট।
এ জন্য বিএনপি আওয়ামী লীগকে বরং আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে পারে। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা লংমার্চের পর আর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে দলের কর্মী-সমর্থকেরা চিড়া-মুড়ি-গুড় নিয়ে আগের দিনই সমাবেশস্থলে পৌঁছেছেন, মাটিতে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন, এমন দৃশ্য বিরল। এসব ছবি সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে। মোটরযান বন্ধ রাখায় তাঁরা নৌকা কিংবা ট্রলারে, ট্রেন ও ভ্যানে চেপে সমাবেশে যোগ দিয়েছেন।
দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং নানা ধরনের মামলা-হামলার পরও বিএনপি দলটি যে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, তা বেশ ভালোভাবেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছে। সমাবেশের আকার বা পরিধি নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু তারাই যে এখনো সরকারের প্রতিপক্ষ, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বরং কিছুটা বিস্মিত যে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও দলটির সমর্থকেরা এসব সমাবেশে হাজির হচ্ছেন। খালেদা জিয়া যখন বাড়িতে বিভিন্ন শর্তের জালে বন্দী এবং দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান যখন কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে নির্বাসনে, তখন নেতৃত্বশূন্যতার কারণে যে ধারণাটি চালু ছিল, তা হলো দলটি ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে।
এই নিবন্ধের আলোচ্য অবশ্য বিএনপির লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ নয়, বরং বিএনপিকে চাপে (শায়েস্তাও পড়তে পারেন) রাখতে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দেওয়া কেন, সেই প্রসঙ্গ। বাস-ট্রাক ধর্মঘট সরকার ডাকেনি ঠিকই, কিন্তু সরকারের কোনো দায় নেই, এমন দাবি দুর্ভোগের শিকার কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে কি উপহাস নয়? বাস-ট্রাকমালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলোয় ক্ষমতাসীন দলের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণের কথা সবারই জানা। যখন যে দল সরকারে থাকে, এসব সমিতিতে তখন সেই দলেরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায়। সুতরাং ক্ষমতাসীন দলের যে এসব ধর্মঘটে ভূমিকা রয়েছে, তা নিয়ে জনমনে কোনো সংশয় নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গণপরিবহন ধর্মঘটকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপান্তরের পরিণতি কি ভালো হবে?
পরিবহন ধর্মঘট আঞ্চলিক হোক কিংবা জাতীয় পরিসরে হোক, তা নিরসনের দায়িত্ব কার? বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাজ কী? সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। রুট পারমিট যে উদ্দেশ্যে ও শর্তে দেওয়া হয়েছে তা ভঙ্গ হলে সরকারের সেই পারমিট বাতিল করার ক্ষমতাও রয়েছে।
হঠাৎ যারা ধর্মঘট শুরু করে, তারা যে স্পষ্টভাবে পারমিটের শর্ত লঙ্ঘন করছে, তা নিয়ে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে? আইন অনুযায়ী সরকার পরিবহন সমন্বয় কমিটির (ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন কমিটি) সভা করে অথবা অন্য কোনোভাবে ধর্মঘট নিরসনের ব্যবস্থা নেবে, সেটাই তো প্রত্যাশিত। অথচ সে রকম কিছু না করে সরকার নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলেই মনে হয়েছে। বিএনপির জনসমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধর্মঘটও শেষ হয়েছে। কোনো দাবি পূরণ হয়েছে অথবা সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে—এমন কিছু শোনা যায়নি। উল্টো ফাঁস হল আওয়ামী লীগের চতুর চাল।
ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে পরিবহন ধর্মঘট
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেছেন, বিএনপির গণসমাবেশের আগে যে ধর্মঘট করা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং সাধারণ শ্রমিক-মালিকদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
পুরোপুরি সরকারের নির্দেশে অতি উৎসাহী পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন আর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে পরিবহন ধর্মঘট করেছে।
গতকাল সোমবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে তাকে নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীদের বক্তব্যের জবাব দিতে তিনি এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন-পরিবহন শ্রমিক নেতা হুমায়ুন কবির খান, এম জেনারেল ইসলাম, এমকে নরেন, শাহাবুদ্দিন রেজা, জাহাঙ্গীর আলম,মঞ্জরুল আলম মঞ্জু ও মাহবুব আলম বাদল প্রমুখ।
শামসুর রহমান শিমুল বলেন, ‘সরকারের জোরপূর্বক এই ধর্মঘটের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পরেছে দেশের সাধারণ মানুষ।পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক, উভয় পক্ষ। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, সড়ক পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিক কোন পক্ষই এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ধর্মঘট চায় না, সবাই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকারের চাপের মুখে, ক্ষমতাসীনদের পেশিশক্তি আর দমন-নিপীড়নের কাছে নিরুপায়। কোন কোন এলাকায় এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, জীবন-জীবিকার তাগিদে সড়কে গাড়ি বের করলে সরকার দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছেন অনেক পরিবহন শ্রমিক।’
তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ধর্মঘটের কারণে সাধারণ মানুষকে নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। জরুরি দরকারে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকাতে যেতে পারেনি মানুষ। এমনকি, সংকটাপন্ন রোগী নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারেনি স্বজনরা। এক কথায় বলা যায়, এই ধর্মঘট গণমানুষের বিপক্ষে।’
সরকার পরিবহন সংগঠনের নাম ব্যবহার করে শ্র্রমিক সংগঠনগুলোকে জনসাধারণের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। বিরোধীদলের শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশের আগে সমাবেশ বানচালের জন্য, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করার জন্য এই ধর্মঘটের আয়োজন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ ৫ নভেম্বর বরিশালের সমাবেশের আগে সড়ক পরিবহন ধর্মঘটের পাশাপাশি রিক্সা,সিএনজি,নৌযান এমনকি খেয়া নৌকা পর্যন্ত বন্ধ করেছিল। এতেই সরকারের উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তারপরও সরকারের মন্ত্রীরা অন্যায়ভাবে আমার নামে মিথ্যাচার করছে।উপরোন্ত সেবামুলক সড়ক পরিবহন সেক্টরকে সরকার পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্য ফেলে দিয়েছে। সরকারের পাতানো এই ধর্মঘটরে সাথে সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিকদের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
শিমুল বিশ্বাস বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, এমনকি জাতীয় সংসদেও বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা। গত বুধবার জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে পরিবহন ধর্মঘট প্রসঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এমনকি এই ইস্যুতে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও প্রতিনিয়ত মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছেন।’ এ ধরনের অসত্য কথা বলে নিজের দোষ গোপন করে অন্যের ওপর দোষ না চাপানোর জন্য আহ্বান জানান তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিমুল বিশ্বাস বলেন, ‘ইতোপূর্বের দুই একটি ছোট ঘটনার কারণে সরকার বড় বড় অন্যায় ধামাচাপা দিতে পারে না। ইতোপূর্বে কোন সরকার দেশ ও জনগণকে জিম্মি করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় নাই।’
এসডব্লিউ/এসএস/১২০০
আপনার মতামত জানানঃ