ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে দেশের বিভিন্ন এলাকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নষ্ট হয়েছে প্রচুর ফসলের। ভেঙে পড়েছে বহু বাড়ি। ঝড়ের দাপটে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে সরকারি হিসাবে নয় জনের এবং বেসরকারিভাবে ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এখনও বহু এলাকা বিদ্যুৎহীন বলে জানা গেছে।
সোমবার সন্ধ্যার পর থেকেই বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে সিত্রাং। সোমবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে বরিশালের কাছে তিনকোণা দ্বীপ ও সন্দ্বীপের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে ঝড়। এখনও পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মোট ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
‘আশি লাখ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে’
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে এখন দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় ৮০ লাখ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ”ঝড়ের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় সবচেয়ে আঘাত পড়েছে। তার ছিঁড়ে, গাছ উপড়ে, পোল ভেঙ্গে পড়ে অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। তার ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে সেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক না করা পর্যন্ত বিদ্যুৎ চালু করা হবে না।”
তিনি জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা এসব লাইন মেরামতের কাজ করছেন। বুধবার দুপুরের মধ্যে তারা শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবেন বলে আশাবাদী।
সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৮০ লক্ষ মানুষ এখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।
শুধুমাত্র পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেরই আটশোর বেশি বিদ্যুতের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশেষ করে সাব স্টেশনের পানি ঢোকায় অনেক স্থানে ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী এলাকার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে দক্ষিণের জেলাগুলোর অনেক এলাকা সোমবার সন্ধ্যা থেকেই বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে।
বরগুনার আমতলীর বাসিন্দা লায়লা রেহানা জানিয়েছেন, সোমবার বিকাল থেকেই সেখানে বিদ্যুৎ চলে গেছে। এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
বিপর্যস্ত রাজধানীবাসীরাও
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সরাসরি প্রভাব না পড়লেও প্রবল বৃষ্টি আর বাতাসের কারণে সোমবার রাজধানী বাসিন্দাদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঢাকার নিউমার্কেট, আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ধানমণ্ডি, গ্রীনরোড, বাসাবোসহ অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার তৈরি হয়।
অনেক সড়কে যানবাহনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
গতকাল দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে বরিশালে, ৩২৪ মিলিমিটার। এরপরেই ঢাকায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৫৫ মিলিমিটার।
মঙ্গলবার দুপুরেও মোহাম্মদপুর, আজিমপুরের বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকায় পানি জমে রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঝড়ের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় সবচেয়ে আঘাত পড়েছে। তার ছিঁড়ে, গাছ উপড়ে, পোল ভেঙ্গে পড়ে অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে।
ঢাকার অনেক এলাকায় গাছ পড়ে যানবাহনের ক্ষতি এবং সড়কে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মঙ্গলবার সকাল থেকে এসব গাছপালা কেটে সরানোর কাজ শুরু করে সিটি কর্পোরেশন কর্মীরা।
মহাসড়কে গাছ পড়ার কারণে সোমবার রাতে ঢাকার সঙ্গে খুলনা ও বরিশালের সড়ক যোগাযোগ কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেসব গাছ সরানোর পর আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার বাড়িঘর
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে সারাদেশের ৪১৯টি ইউনিয়নে ১০ হাজার বাড়িঘর, ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এবং এক হাজার মাছ ধরার ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; প্রাণহানি হয়েছে ৯ জনের।
তবে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত দেশের ১৬ জেলায় ৩৫ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সেখানকার সন্দ্বীপ চ্যানেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও পানিতে ডুবে চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। কুমিল্লায় গাছচাপা পড়ে বাবা, মা ও সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলে ঝড়ের কবলে পড়ে মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য ও এক আসামির মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সচিবালয়ের সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের সুদহীন ঋণ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে
দেশে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ডিসেম্বরে দেশে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এদিকে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের তথ্য বলছে, দক্ষিণ থাইল্যান্ড এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি নিম্নচাপ আন্দামান সাগরের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে আগামী ২ ডিসেম্বরের মধ্যে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এবং সংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করবে।বঙ্গোপসাগরেই সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। এরপর আরও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করবে। পরে ৪ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় সকালে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ-ওড়িশা উপকূলের মাঝামাঝি আছড়ে পড়তে পারে এটি।
তবে ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ-ওড়িশা উপকূলেই আছড়ে পড়বে কি না- সেটি নিশ্চিত নয়। কারণ ঘূর্ণিঝড় যে কোনো সময় গতিপথ পালটাতে পারে।বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর এ বিষয়ে সতর্ক করেছে।
বরাবরই অপ্রস্তুত থাকে সরকার ও প্রশাসন
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা। বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর সাত–আটবার নিম্নচাপ তৈরি হয়। এর মধ্যে কোনোটি শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এই ঘূর্ণিঝড় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতের ওডিশা ও অন্ধ্র উপকূল এবং বাংলাদেশে আঘাত হানে।
আবহাওয়ার চক্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবণতা কোনো কোনো দশকে হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছর একটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করছে। এর আগে আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেখা গেছে, প্রতি তিন–চার বছরে একটি করে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানত।
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশে আঘাত করে। এরপর ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমরা দেখলাম প্রতিবছর এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও বরাবরই অপ্রস্তুত থাকে দেশ। প্রতিবারই মনে হয় যেন দেশে প্রথম ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। নেই দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও সে অনুযায়ী পরিকল্পনা।
তারা বলেন, দেশের অঞ্চলগুলোকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য আরও বেশি করে প্রস্তুত করতে হবে। বেড়িবাঁধগুলো সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর তা এখনো পরিপূর্ণভাবে মেরামত করা হয়নি। অনেক এলাকা এবং দ্বীপে বেড়িবাঁধও নেই। ফলে চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে এমনিতেই ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব উপকূলীয় এলাকাকে এখন থেকেই প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করতে হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে সরকারের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৪
আপনার মতামত জানানঃ