করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে ধুঁকছেন কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তা ও খুদে উদ্যোক্তারা। সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণদানের ব্যবস্থা করলেও সরকারের নীতি ও অন্যান্য সংকটের কারণে কুটিরশিল্পী ও খুদে উদ্যোক্তারা তার সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ নিয়ে কয়েক পর্বের আলোচনার আয়োজন করে। তাতে সকলেই স্বীকার করেন যে এ প্রণোদনা প্যাকেজের যেটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তার অধিকাংশ মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছেই গেছে। কুটির ও মাইক্রো উদ্যোক্তারা কিছুটা হতাশাগ্রস্ত। এদের মধ্যে অনেকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন, ঋণ পাওয়ার আশা ত্যাগ করেছেন।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম সম্প্রতি এ বিষয়ে এক নিবন্ধে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত সার্কুলার এবং সার্কুলার লেটারসহ মোট প্রায় ৩০ ধরনের বেশি নির্দেশনা দিয়েছে গত এপ্রিল থেকে। তবে সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে বোঝা গেলেও এসব সার্কুলার খুদে উদ্যোক্তাদের খুব একটা সুবিধা দিতে পারেনি।
গত নভেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট প্রণোদনা প্যাকেজের যে ৪১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে, তার বেশির ভাগই পেয়েছেন মধ্যমশ্রেণীর উদ্যোক্তারা। নারী, কুটির শিল্পী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ব্যাংকগুলো কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের মাত্র ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। খুদে উদ্যোক্তারা গড়ে জনপ্রতি অর্থ পেয়েছেন দেড় লাখ টাকার মতো। অন্যদিকে কিছুটা বড় উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ১৫ লাখ থেকে সাড়ে ১৫ লাখ টাকার মতো।
ঝিনাইদহের একজন ব্যবসায়ী নেতা খুদে উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানান, সরকারের প্রচেষ্টায় জেলা পর্যায়ে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অতি ক্ষুদ্র শিল্পগুলো খুব আশা করে এ সভাগুলোয় উপস্থিত থেকেছে, ব্যাংকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ট্রেড লাইসেন্সও তৈরি করেছে কিন্তু তারা ঋণ পায়নি, তার অন্যতম বড় কারণ ৫০ হাজার টাকা ঋণের জন্য তারা যে পরিমাণ সম্পদ বন্ধক রাখতে চেয়েছে, তা প্রায় তার সারা জীবনের সম্পদ। এছাড়া তাদের অনেকের কাছে পর্যাপ্ত জমি, ঘরবাড়ি বন্ধক দেয়ার মতো মজুদ নেই। তাই তারা শেষ পর্যন্ত উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। অন্যদিকে শোনা যায়, কন্ট্রাক্টর, ঠিকাদারদের মতো এলাকায় যাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি রয়েছে, তারা ঋণের সিংহভাগ নিয়ে গেছেন। কাজেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এ প্রণোদনার ঋণ খুব একটা কাজে আসেনি।
স্থানীয় প্রতিনিধি, যারা এ কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছেন, তারাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তারা হতাশা প্রকাশ করে বলছেন এত যে আলোচনা, এত লেখালেখি, দেনদরবার, অ্যাডভোকেসি, তার কোনো দাম রইল না। অভিযোগ, সরকারের নীতি নারী ও খুদে উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক নয়। তাদের প্রশ্ন, উদ্যোক্তাদের মধ্যে যিনি অনেক কষ্ট করে ট্রেড লাইসেন্স করলেন, তিনি ৫০ হাজার টাকা ঋণের জন্য কোলেটারেল, গ্যারান্টর কোথা থেকে দেবেন। উদ্যোক্তারা বরং এমন ভাবছেন যে, ঋণের ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে ভালো অন্তত বসতভিটাটুকু থাকুক, আর কোনোমতে দিন কাটুক দারিদ্র্যকে আলিঙ্গন করে।
বাগেরহাট চেম্বারের আরেক প্রতিনিধিও বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগমকে একই অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, ওখানকার নারী উদ্যোক্তারা বিশেষ সমস্যায় পড়েছেন। এতদিন কিছুটা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন নেই। মূলত বন্ধক সম্পত্তি, গ্যারান্টর সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমি জানতে চাইলাম চেম্বারগুলো তো গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করতে পারে। তারা জানালেন, সে চেষ্টাও করা হয়েছে কিন্তু ঋণের অর্থ আর পাওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ঘোষণা করেছে, তবে সুদহার, বন্ধকি নীতি কী রকম হবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। শোনা যায় প্রায় আটটি ব্যাংক এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। দেখা যাক এদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণোদনা প্যাকেজের গাইডলাইন অনুযায়ী, ঋণের ৬৫ শতাংশ দেয়া হবে উৎপাদন খাতে এবং বাকি ৩৫ শতাংশ দেয়া হবে ট্রেডিং খাতে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ দেয়া হবে কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। হিসেব কষে দেখা যায়, ১৪ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে এদের জন্য এবং বাকি ৬ হাজার কোটি রাখা হয়েছে মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য। অন্যদিকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। এই ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অংশ থেকে আসবে কিনা, তা পরিষ্কার নয়। রংপুর মহিলা চেম্বার প্রতিনিধি জানালেন, এক বছরের মধ্যে এ অর্থ ফেরত দিতে হবে। এটা এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য খুব সুখকর নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে যেভাবে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, বিশ্বে এখন আর তেমনটা করা হয় না। কুটির শিল্পকে অন্যান্য দেশ ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যেই গণ্য করে থাকে। আর কেবল বাংলাদেশেই কুটির শিল্পকে ফেলা হয় মাঝারিদের কাতারে। কুটির শিল্প এই কাতারে পড়ার কারণে প্রাপ্য সুবিধা ও সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখানে সংস্কার হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনায় এবং তথ্য আদান-প্রদানে সুবিধা হতে পারে। তবে নীতিগত প্রশ্নে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এ ধারার শিল্পের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে এগুলোকে আলাদা করা।
ভ্যাট ও এসডি ২০১২ আইনে বলা হয়েছে, সে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত তারা মূল্য সংযোজন করের আওতার বাইরে থাকবেন। আর ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভার যাদের, তারা ১৫ শতাংশের পরিবর্তে কর দেবেন ৪ শতাংশ হারে। কিন্তু শিল্পনীতিতে ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশের যে নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে, করের এমন হার তার অনুকূল নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্ত প্রকারের উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করা গেলে অর্থায়নের গাইডলাইনটিও সেভাবে প্রণয়ন করা যাবে।
ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ এবং এ খাতের উদ্যোক্তাদের রক্ষা করতে হলে প্রথমে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে যে কোন কোন শিল্প এই শ্রেণির মধ্যে পড়ে। তা না হলে গাইডলাইন ঠিকই থাকবে, তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে কিন্তু যাদের জন্য নীতিমালাটি করা হয়েছে, তারা এর কোনো সুফল পাবেন না। শোনা যাচ্ছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের (সিএমএসএমই) জন্য নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। সেখানে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্রদের জন্য আলাদা গাইডলাইনও থাকা দরকার। কারণ তাদের উদ্যোগের চরিত্র, প্রয়োজন ও সক্ষমতা ভিন্ন।
এসডাব্লিউ/বিবি/আরা/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ