আরবি হলো বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত কথ্য ভাষাগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবহারের দিক থেকে এটি পঞ্চম স্থানে, যা আজকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা জুড়ে একটি সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি এর ব্যবহার বিভিন্ন উপভাষাতেও রয়েছে।
আরবি ভাষা মুসলিমদেরর কাছে একটি ধর্মীয় ভাষা হিসেবেও কাজ করে। কারণ, আরবি হলো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষা, এবং এটি ইসলাম ধর্মের সাথে সরাসরি যুক্ত। এভাবে এই ভাষা ধর্মীয় তাৎপর্যের সাথে সাথে ঐশ্বরিক উদঘাটনের সাথেও যুক্ত, যা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
জনপ্রিয় এই আরবি ভাষা কোথা থেকে এসেছে? এর জন্ম কীভাবে হলো? এটাই আজকে জানবো আমরা।
আরবি ভাষাকে আরবিতে ‘আল আরাবিয়া’ বলা হয়। প্রায় ২৯৩ মিলিয়ন স্থানীয় ভাষা ব্যবহারকারী, এবং বিশ্বব্যাপী মোট ৪২২ মিলিয়ন মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলেন। বিশ্বের ২৬টি দেশের অফিসিয়াল ভাষা আরবি। এটি জাতিসংঘের ছয়টি অফিসিয়াল ভাষার মধ্যে একটি।
কুরআনের ভাষা হিসেবে এটি সারা বিশ্বের ১.৭ বিলিয়ন মুসলমানের ধর্মীয় ভাষাও। যদিও তাদের অধিকাংশই আরবি ভাষায় মনের ভাব আদান-প্রদান পারে না, কিন্তু প্রার্থনা এবং ধর্মীয় অধ্যয়নের জন্য আরবি ভাষা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান তাদের অধিকাংশেরই রয়েছে।
আরবি একটি সেমিটিক ভাষা, যা মূলত আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা-পরিবারের একটি অংশ। এটি এই পরিবারের প্রোটো-সেমিটিক শাখা থেকে এসেছে।
এর অর্থ হলো এটি সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্যান্য উপগোষ্ঠীর (যেমন- উত্তর-পশ্চিম সেমিটিক, সেন্ট্রাল সেমিটিক, দক্ষিণ সেমিটিক, পূর্ব সেমিটিক, পশ্চিম সেমিটিক) ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যার মধ্যে রয়েছে হিব্রু, আরামাইক, সিরিয়াক, ফিনিশিয়, মিশরীয়, ক্যানানাইট, প্রাচীন উত্তর ও দক্ষিণ অ্যারাবিয়ান এবং ইথিওপীয়সহ অন্যান্য অসংখ্য মৃত ও সকল জীবিত আধুনিক ভাষা।
যদি কেউ এই ভাষাগুলোতে কথা বলতে পারে, তা হলে বুঝতে পারবে এদের মধ্যে কত মিল আছে। উদাহরণস্বরূপ, শুধু আরবি এবং হিব্রুতে সালাম এবং শালোমের মতো একটি শব্দের দিকে তাকানো যায়, যার উভয়েরই অর্থ ‘শান্তি’।
সেমিটিক ভাষার উপগোষ্ঠীর সর্বোত্তম শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে ভাষাবিদদের মধ্যে এখনও ভিন্নমত দেখা যায়। সেমিটিক ভাষাগুলো প্রোটো-সেমিটিক এবং মূল বা সেন্ট্রাল সেমিটিক ভাষার উদ্ভবের মধ্যে; বিশেষত ব্যাকরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়- আরবি ভাষা সেমিটিক ভাষা পরিবার থেকে এসেছে এবং এটি ঐ পরিবারের অন্যান্য সেমিটিক ভাষার সাথে বিকশিত হয়েছে। সেই দিক থেকে বিশেষ করে আরবি ভাষা মূলত কোনো নির্দিষ্ট কোন ভাষা বা কোথা থেকে এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ ভাষা সর্বদা পরিবর্তিত এবং বিকশিত হয়।
আরবি এবং অন্যান্য সেমিটিক ভাষা – যেমন- হিব্রু, আরামাইক এবং ফিনিশিয় সব একই প্রোটো-সেমিটিক ভাষা থেকে বিকশিত হয়েছে। আরবি ভাষা মূল বা সেন্ট্রাল সেমিটিক শাখার অন্তর্গত একটি ভাষা। যেখানে সেন্ট্রাল সেমিটিকের আরেকটি শাখা থেকে হিব্রু, আরামাইক এবং ফিনিশিয় ভাষাগুলো এসেছে।
সেমিটিয় গোত্রের ভাষাসমূহের অন্তর্গত জীবিত সেমিটিক ভাষাগুলো হলো আধুনিক হিব্রু ভাষা (ইসরায়েলের ভাষা), আমহারীয় (ইথিওপিয়ার ভাষা), এবং ইথিওপিয়ায় প্রচলিত অন্যান্য ভাষা। মৃত সেমিটিয় ভাষাগুলোর মধ্যে আছে প্রাচীন হিব্রু, আক্কাদীয় (ব্যাবিলনীয় ও আসিরীয়), সিরীয় ও ইথিওপীয় ভাষা।
বহু আরব বিশেষজ্ঞ আরবি ভাষার উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আল ক্বালবি তার লিখিত কিতাব আল-আসাম বইয়ে লিখেছেন, ব্যাবিলন থেকে আসা আমালিয়ার জায়ান্টরাই প্রথম আরবিতে কথা বলতেন, এবং তাদের সাথে এটি আরব ভূখণ্ডে ছড়িয়ে দেন।
এছাড়া একটি জনপ্রিয় ও ব্যাপক গৃহীত তত্ত্ব ও ধারণা হলো- আরবি ভাষা দক্ষিণ আরব ও আধুনিক ইয়েমেনের আশেপাশে উদ্ভূত হয়েছে, এবং পরে এটি উত্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
পাঠক, চলুন দেখে আসি ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার থেকে আরবি ভাষা কীভাবে এলো তার একটি সম্ভাব্য প্রবাহ চিত্র।
আফ্রো-এশীয় > সেমিটিক > পশ্চিম সেমিটিক > সেন্ট্রাল সেমিটিক > উত্তর আরবীয় ভাষা > আরবি ভাষা
প্রাচীনকালে আরবের অধিবাসীরা বিভিন্ন সেমিটিক ভাষায় কথা বলত। দক্ষিণ-পশ্চিমে, প্রাচীন দক্ষিণ আরব পরিবারের (যেমন- দক্ষিণ থামুডিক) অন্তর্গত এবং এর বাইরের বিভিন্ন সেন্ট্রাল সেমিটিক ভাষার ব্যবহার ছিল।
বিশ্বাস করা হয়, আধুনিক দক্ষিণ আরবীয় ভাষার (নন-সেন্ট্রাল সেমিটিক ভাষা) পূর্বপুরুষরাও এই সময়ে দক্ষিণ আরবের ভাষায় কথা বলত।
উত্তরে, উত্তর হিজাজের মরূদ্যানে, দাদানিটিক এবং তায়মানিটিক শিলালিপির ভাষাগুলোর কিছুটা প্রতিপত্তি ছিল। নজদ এবং পশ্চিম আরবের কিছু অংশে ‘থামুডিক সি’ নামে শিলালিপিতে প্রাপ্ত একটি ভাষা পণ্ডিতরা খুঁজে পেয়েছেন। পূর্ব আরবে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে হাসাইটিক নামে পরিচিত একটি ভাষার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এছাড়া, আরবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, থামুডিক বি, থামুডিক ডি, সাফাইটিক এবং হিসমাইক নামে পণ্ডিতরা চারটি বিভিন্ন ভাষা পেয়েছেন। ভাষাপণ্ডিতদের প্রাপ্ত তত্ত্বের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, সাফাইটিক এবং হিসমাইক প্রকৃতপক্ষে আরবি ভাষার প্রাথমিক রূপ এবং সেগুলোকে পুরনো আরবি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
সমগ্র আরব বিশ্ব জুড়ে এই উপভাষাগুলি প্রচলিত এবং আধুনিক আদর্শ আরবি ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র পড়া ও লেখা হয়। আধুনিক আদর্শ আরবি চিরায়ত আরবি থেকে উদ্ভূত। মধ্যযুগে আরবি গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রধান বাহক ভাষা ছিল। বিশ্বের বহু ভাষা আরবি থেকে শব্দ ধার করেছে।
ধর্মীয় ভাষা হিসাবে আরবী ভাষার ভিত্তি বেশ মজবুত। ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরানের ভাষা হচ্ছে আরবী। ইসলামের প্রচারকেরা ৭ম শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে এক বিশাল আরব সাম্রাজ্য গড়তে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে দামেস্ক ও পরে বাগদাদে তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। এসময় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এক বিশাল এলাকা জুড়ে আরবিকে প্রধান প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হত।
আরবি ভাষা বহু প্রাচীন বলে ধারণা করা হয়। তবে এই ধারণার কোন ভিত্তি নাই। এই ভাষার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় ৫১২ খ্রিস্টাব্দে। ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের ঠিক আগের যুগে আরব উপদ্বীপে আরবি ভাষার উৎপত্তি ঘটে। প্রাক-ইসলামী আরব কবিরা যে আরবি ভাষা ব্যবহার করতেন, তা ছিল অতি উৎকৃষ্ট মানের। তাদের লেখা কবিতা মূলত মুখে মুখেই প্রচারিত ও সংরক্ষিত হত। আরবি ভাষাতে সহজেই বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রয়োজনে নতুন নতুন শব্দ ও পরিভাষা তৈরি করা যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ