কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসি নজিরবিহীন এক ঘটনায় একটি সংসদীয় আসনের গোটা নির্বাচনই স্থগিত করল। সাত মাস বয়সী এই ইসির অধীনে এটাই ছিল কোনো সংসদীয় আসনের প্রথম নির্বাচন; আর সেখানেই তারা এই ঘটনা ঘটাল ঢাকায় থেকেই।
বিএনপি ভোটে নেই, ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ঘরোয়া বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী। তবু শেষ নামানো গেল না গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচন। অনিয়ম-অনাচার সামলাতে না পেরে ঘণ্টা ছয়েক ভোট নেওয়ার পর পুরো নির্বাচনই বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে নির্বাচন কমিশন।
চার প্রার্থীর ভোট বর্জনের পর গতকাল বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে নির্বাচন কমিশন থেকে উপনির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে শুরুতে অবাক হয় আওয়ামী লীগ। পরে ফল ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ, অবরোধ করে তাদের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা। আর জাপা তুলেছে ভোটের পুনঃ তফসিল ঘোষণার দাবি। ভোটের বাইরে থাকা বিএনপি বলছে, এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা।
গত ২২ জুলাই ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া মারা গেলে গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফাঁকা হয়। সেই উপনির্বাচনে গতকাল সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সবগুলো কেন্দ্রের ভোট হচ্ছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্নের কথাও জানিয়েছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও রাজশাহী আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম।
কিন্তু ভোট শুরুর দু-তিন ঘণ্টা পর সিসি ক্যামেরায় ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিইসি হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন বুধবার (১২ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেছে। অনিয়মের কারণে ইসি প্রথমে কয়েক দফায় ৫১টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে। একপর্যায়ে তারা পুরো ভোটই বন্ধ করে দেয়। এর আগে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই স্বীকার করেন— গাইবান্ধা নির্বাচন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। গোপন কক্ষে ঢুকে একজনের ভোট আরেকজনের দেওয়া তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো একটি পক্ষ বা কোনো একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে, আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, ভোট গ্রহণ নিরপেক্ষ হচ্ছে না।’
জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু (লাঙ্গল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক) সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা কেন্দ্রে একত্র হয়ে একযোগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এতে ভোটের মাঠে যান শুধু একজন প্রার্থী— আওয়ামী লীগের মাহমুদ হাসান রিপন।
ভোট বর্জন করা প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেওয়া, ইভিএমে জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ তোলেন। পাশাপাশি ফের তফসিল ঘোষণা করে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবিও জানান তারা।
সাধারণ ব্যালট যদি দখল করা যায়, ইভিএম থাকলেই দখল করা যাবে না, এ ধারণা তাদের কে দিল। ভোট যেভাবেই হোক। সুষ্ঠু ভোটের সদিচ্ছা এবং নিরপেক্ষ থাকার ইচ্ছাটাই বড়।
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন ইসিকে (নির্বাচন কমিশন) নতুন করে ভাববার পথ তৈরি করে দিয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। অনিয়মের অভিযোগে একটি সংসদীয় আসনের পুরো ভোট বন্ধ হয়ে যাওয়া নজিরবিহীন ঘটনা; তাই ইভিএম ব্যবহারসহ ইসির সামগ্রিক নির্বাচনি পরিকল্পনার বিষয়টি পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, “এটা যেহেতু অনিয়মের প্রতিবাদে; এটা একটা ভালো উদ্যোগ। বন্ধ করায় জনগণের কাছে বার্তা যাবে- ইলেকশনে যদি অনিয়ম, জালিয়াতি হয় তাহলে নির্বাচন বন্ধ হতে পারে; ইসি ভোট বন্ধ করে। যারা প্রার্থী, দল তারাও সতর্ক হবে।”
গাইবান্ধার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে তো বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। ইসির নিজস্ব প্রশাসন নেই, পুলিশ নেই, আনসার নেই। কাজেই বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।”
তিনি মনে করেন, একটা ছোট উপ-নির্বাচন হলেও তিনশ’ আসনের জাতীয় নির্বাচনে একই অবস্থা থাকবে না।
ইসির সঙ্গে ডিসি-এসপিদের বৈঠকে হৈ চৈ এর ঘটনা আগামী দিনে ভোটের জন্য তেমন প্রভাব না পড়লেও এখন থেকে নজর রাখতে হবে বলে মনে করেন আলীম।
দেশের অন্যতম পুরোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রধান মুনিরা খান বলেন, ‘আজ পর্যন্ত এই নির্বাচনে যে খরচ হলো, কিন্তু তারা সফল হলো না। এর জবাবদিহি কার কাছে দেবে ইসি? সাধারণ ব্যালট যদি দখল করা যায়, ইভিএম থাকলেই দখল করা যাবে না, এ ধারণা তাদের কে দিল। ভোট যেভাবেই হোক। সুষ্ঠু ভোটের সদিচ্ছা এবং নিরপেক্ষ থাকার ইচ্ছাটাই বড়। কী করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, এ বিষয়ে ইসিকে আরও সতর্ক হতে হবে।’
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘এখন যেহেতু দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই এবং সবকিছু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! সে রকম পরিবেশে বিশ্বাস কিংবা পারস্পরিক আস্থা থাকে না, আমাদের সংকট এখানে। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ইভিএম হোক কিংবা অন্য পদ্ধতিতে হোক, সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে পরিবেশ, আস্থা ও বিশ্বাস থাকা দরকার, সেটি নেই।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৯
আপনার মতামত জানানঃ