ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ ইউনিটের রি-পাওয়ারিং এর পিছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তবুও মিলছে কোনো ফল। নকশাগত ত্রুটির কারণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ২০১ মেগাওয়াট থেকে ৪০৯ মেগাওয়াটে উন্নীত লক্ষ্যে ২ হাজার ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে রি-পাওয়ারিং প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
ইতোমধ্যে, প্রকল্পের ভৌত কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হওয়ার পর প্রি-কমিশনিং টেস্ট শেষে দেখা যায়, উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট। যদিও নতুন করে এতে যোগ হওয়ার কথা ছিল ১৯৯ মেগাওয়াট।
এখন নতুন করে স্টিম টারবাইন স্থাপন করলে টার্গেট অনুযায়ী এই ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। তবে, এর জন্য অতিরিক্ত ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
২১০ মেগাওয়াটের ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট উৎপাদনে আসে ১৯৮৯ সালে। উৎপাদন সক্ষমতা ১৮০ মেগাওয়াটে নেমে যাওয়ায় ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই ইউনিটের রি-পাওয়ারিংয়ের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রকল্পটিতে গ্যাসের চাহিদা মাত্র ৩০ শতাংশ বাড়ালেই উৎপাদন হবে দ্বিগুণেরও বেশি। এতে নির্দিষ্ট জ্বালানি খরচও কমবে ৪৪ শতাংশ।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুসারে, চতুর্থ ইউনিটের রি-পাওয়ারিং বা পুনঃশক্তিকরণের জন্য ২০১৬ সালের জুনে চীনের একটি এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর, চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) প্রায় ২৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন টারবাইন মডেল ইনস্টল করে। সে সময় থেকে সিম্পল সাইকেল মোডে চলছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
প্রকল্পের অধীনে, ইপিসি ঠিকাদার একটি নতুন গ্যাস টারবাইন, একটি জেনারেটর, একটি হিট রিকভারি স্টিম জেনারেটর এবং অন্যান্য সহায়ক জিনিসপত্র সরবরাহ করেছে। তবে বিদ্যমান ২১০ মেগাওয়াটের এই টারবাইনটি ব্যবহৃত হয় কম্বাইন্ড সাইকেলের ক্ষেত্রে। প্রকল্পের প্রি-কমিশনিং কাজ শেষে, কম্বাইন্ড স্টিম টারবাইনটি রোলিং মোডে রাখা হয় এবং প্রতি মিনিটে এটি ৩ হাজার রেভল্যুশনে পৌঁছায়; কিন্তু উচ্চ শ্যাফট কম্পনের কারণে টারবাইনটি সর্বপরি সিঙ্ক্রোনাইজ করতে ব্যর্থ হয়।
২০২০ সালের ২৩ জুলাই টারবাইনটি সিঙ্ক্রোনাইজ করা হলেও উচ্চ শ্যাফট কম্পনের কারণে এটি বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যবেক্ষণের পর, একই বছর ৯ অক্টোবর আবারও কমিশনিংয়ের কাজ চালু করে ইপিসি। কিন্তু কম্পন তখনও বেশিই ছিল।
প্রকল্পের কম্বাইন্ড সাইকেলের প্রি-কমিশনিং কাজ শেষ হওয়ার পর, বিদ্যামান স্টিম টারবাইনকে রোলিং মোডে দেওয়া হলে শ্যাফট ভাইব্রেশন বা কম্পন বেশি থাকার কারণে স্টিম টারবাইন বন্ধ হয়ে যায়।
এতে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৪০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, ১৬৯ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইপিসি চুক্তিতে স্টিম টারবাইনের কোনো কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। স্টিম টারবাইনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
ইপিসি চুক্তিতে স্টিম টারবাইনের কোনো কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। স্টিম টারবাইনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
সম্প্রতি নরসিংদীর ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
দেশের জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে মঙ্গলবার দুপুর দুইটা পাঁচ মিনিটে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের সব এলাকার বিদ্যুৎ একসঙ্গে চলে যায়। সংস্কার কাজ শেষে রাত ৯টার দিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একে একে পুরো লোডে ফিরে আসতে সময় লাগে আরও কয়েক ঘণ্টা। তবে কি কারণে এই বিপর্যয় সেটা তাৎক্ষণিক জানা যায়নি।
প্রাথমিক তদন্তে কমিটির সদস্য অধ্যাপক আব্দুল হাসিব চৌধুরী জানান, এখানকার সঞ্চালন লাইনের কোনো একটি ইন্টারকানেকশনের মধ্যে ত্রুটির কারণে এই ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ, ২০১৪ সালের বিপর্যয়ের পরও সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়নি।
তিনি বলছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন ও বিতরণের সঙ্গে সঞ্চালন ব্যবস্থার সমন্বয়হীনতার কারণেই মঙ্গলবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো একটি লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্য লাইন ওভার লোড হয়ে সেটা ট্রিপ করে। এ কারণে পূর্বাঞ্চলের গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বল্পতা দেখা দেয়।
এদিকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পাঁচদিনেও চালু করা যায়নি বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া নরসিংদীর ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫ নম্বর ইউনিট। তবে আগামী সোমবার (১০ অক্টোবর) ফের এ ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম।
প্রধান প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, ৫ নম্বর ইউনিটটির সেফটি বাল্ব ফেটে যাওয়ায় চালু করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটল। গত ৬ সেপ্টেম্বরও মাঝারি গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল, কুষ্টিয়া, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল। বাংলাদেশে বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালের ৩ মে। সেবার আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ের পর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। এর আগে ২০১৪ সালে গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। অর্থাৎ নিয়মিত বিরতিতেই চলছে গ্রিড বিপর্যয়, এতে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সঠিক তদন্ত করে সঠিক কারিগরি ও বিনিয়োগ পদক্ষেপ দরকার। গতানুগতিক তদন্ত ও গল্পনির্ভর রিপোর্ট বানিয়ে চালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যুতের ‘ব্ল্যাকআউট’ থামবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৪
আপনার মতামত জানানঃ