দু’দিন আগেই রাজবাড়ী জেলায় ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হেয় করার অভিযোগে একজন নারীকে গ্রেফতার করা হয়। গত কয়েক বছরে এটাই বাংলাদেশের চিত্র। এ দেশে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের মন্ত্রীদের হেয় করার অভিযোগে প্রায়ই অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্তদের বা উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সমালোচনা যাতে বন্ধ করা যায় সেজন্য বিভিন্ন আইন ব্যবহার করে মামলা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজবাড়ির বাসিন্দা সোনিয়া ইসলাম স্মৃতির বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। সোনিয়া ইসলাম স্মৃতি স্থানীয় বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত। মামলাটি করা হয় বাংলাদেশ দণ্ড বিধির আওতায়। এক মাস আগের একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে মামলাটি হয়েছে। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
সোনিয়া ইসলামের আইনজীবী মোহাম্মদ তসলিম আহমেদ বলেন, মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর মানসম্মান ক্ষুণ্ণ করেছেন। তিনি বলেন, ফেসবুকে তিনি তার নিজস্ব আইডিতে একটা পোস্ট নাকি দিয়েছেন। তাতে নাকি আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মান-সম্মান হানি ঘটছে। যদিও সোনিয়া ইসলাম স্মৃতি যে পোস্ট দিয়েছেন সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নাম বা পদবী কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
আইনের অপব্যবহার
ফেসবুক কিংবা অনলাইন প্লাটফর্মে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ব্যবহার করে।
তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিন বলছে, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
এছাড়া পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারাও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন রাজবাড়ির সোনিয়া ইসলাম স্মৃতির বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ধারায় মামলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে যত মামলা হয়েছে সেগুলো প্রধানমন্ত্রী নিজে কিংবা তার পরিবারের কোন সদস্য সেসব মামলা দায়ের করেননি।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, কারো যদি মানহানি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি মানহানির অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করতে পারেন।
তিনি বলেন, সবসময় তার পক্ষেই যে করতে হয় সেটা নয়। কারণ হচ্ছে, তার সম্মান ক্ষুণ্ণ হলে যারা জড়িত তাদেরও যদি সম্মান ক্ষুন্ন হয়, তাহলে তারা মামলা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধেও তথাকথিত কটূক্তির অভিযোগে বিভিন্ন সময় মামলা হয়েছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন।
তারা মনে করছেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করছেন, মামলার উপাদান ছিল বলেই এসব মামলা হয়েছে। তবে সম্প্রতি এসব আইন নিয়ে সমালোচনার মুখে সরকারের তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে এগুলোর অপব্যবহার করা হবে না।
সমালোচনা-কৌতুকও মানহানি?
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনা কিংবা নিছক কৌতুককে মানহানি হিসেব বিবেচনা করে মামলা করা হচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মামলা করছে তৃতীয় পক্ষ।
কিছু শর্তসাপেক্ষে মতপ্রকাশের অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত রয়েছে। মন্ত্রী, এমপি কিংবা রাজনীতিবিদদের কাজের সমালোচনা করার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা।
সেক্ষেত্রে মামলা দায়ের করা হলে সেটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত হিসেব ধরে নেয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, যারা পলিটিকাল ফিগার রয়েছেন তারা জণগণের সেবক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জণগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা রয়েছে।
তিনি বলেন, তাদের কোন ধরণের কার্যকলাপ, তাদের কোন অনিয়ম, কোন ধরণের দুর্নীতি; সেগুলো যদি পাবলিক ইন্টারেস্টের বিষয় হয় এবং সেগুলোর সমালোচনার ক্ষেত্রে যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় তাহলে সেটি মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশাল বাধা।
আর কত হয়রানির শিকার হতে হবে?
২০১৮ সালে যখন জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়েছিল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধ দমন করতে এই পদক্ষেপ। এটি সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না।
যদিও গত প্রায় ৩৩ মাসের অভিজ্ঞতা হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করতেই আইনটি যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের অবমাননায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুই বছরে দুই শর বেশি মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলা করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এতে আরও বলা হয়, জানুয়ারি ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ৮৯০টি মামলা হয়। প্রথম ১৫ মাসে গড়ে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরবর্তী ৯ মাসে গড়ে ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু ধারা আছে, যা কেবল নাগরিক অধিকার খর্ব করে না, সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের সুযোগও মারাত্মকভাবে সংকুচিত করেছে। আইনটির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো এর বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। অর্থাৎ বিচার করার আগেই অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়া। কারাগারে থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা মোকাবিলা করা কিংবা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা কঠিন।
উল্লেখিত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হলেও বিচার হয়েছে খুবই কম। যারা মামলা করেছেন, তারাও জানেন এটি প্রমাণ করতে পারবেন না। তাদের উদ্দেশ্য বিবাদীকে নাজেহাল করা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে, এ কথা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছেন। তিনি একাধিকবার এর অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে কিছুই করেননি। এভাবে আশ্বাসের মুলা আর কত দিন ঝুলিয়ে রাখবেন? গণবিরোধী আইনে আর কত মামলা হবে, আর কত মানুষ হয়রানির শিকার হবেন?
আইনমন্ত্রীর মিথ্যা আশ্বাস
চলতি বছরের শুরুতে যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। বাক স্বাধীনতা হরণের জন্য নয়। এ আইনে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে তা তদন্তের জন্য নির্ধারিত সেলে পাঠাতে হবে
আনিসুল হক বলেন, এই আইন যখন বাস্তবায়ন করা হয় সেখানে কিছু মিসইউজ ও কিছু অ্যাবিউস হয়েছে। এগুলো যাতে না হয় সে বিষয়ে আমাদের সজাগ এবং সচেতন থাকতে হবে। অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে বলে জানান তিনি।
এরপর মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে গ্রেফতার না করে আগে অভিযোগটি ওই আইনে দায়ের করা যায় কি না- তা যাচাই করে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ