হঠাৎই এল সেই মুহূর্ত— ‘ইউরেকা!’ তৈরি হল অপরাধী শনাক্তকরণের নতুন পদ্ধতি। গোটা বিশ্বের সামনে এল ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভেরিফিকেশন’। উনবিংশ শতকের শেষের দিক দুই বাঙালি— কাজী আজিজুল হক, সঙ্গে হেমচন্দ্র বসুর হাত ধরেই এসেছিল এই অভূতপূর্ব আবিষ্কার।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আঙুলের ছাপের ব্যবহার যে কতরকম ভাবে হয়, সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না। অপরাধবিজ্ঞান বলে, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের আঙুলের ছাপই আলাদা, কারও সঙ্গে কারোর আঙুলের ছাপের হুবহু মিল নেই। অপরাধী শনাক্তে পুলিশ-গোয়েন্দাদের বড় ভরসা আঙুলের ছাপ। শুধু কি অপরাধী শনাক্ত? আজকের দিনে আঙুলের ছাপ হয়ে উঠেছে আমাদের পরিচয় শনাক্তের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে এক ধাক্কায় বিজ্ঞান এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা পথ।
উনবিংশ শতকে এসে এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের রহস্য ভেদ করেন স্যার ফ্রান্সিস গোল্ট। একজনের সঙ্গে আরেকজনের আঙুলের ছাপের যে ফারাক, সেটা তিনিই প্রথম ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আবিষ্কার হলেও, অপরাধ বিজ্ঞানে তখনও প্রবেশ করেনি এই পদ্ধতি। আঙুলের ছাপকে কী করে একটি নির্দিষ্ট ছকে ফেলে অপরাধীকে কাবু করা যায়, সেটা বের করার চেষ্টা তখনও করে যাচ্ছেন অনেকে।
কলকাতাতেও সেই চেষ্টা শুরু করেছেন বেঙ্গল পুলিশের তৎকালীন আইজি এডওয়ার্ড হেনরি। কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারছেন না। বুঝতে পারলেন, এমন কাজে সাহায্য করতে পারবেন এমন কেউ, যার অঙ্ক ও পরিসংখ্যান বিদ্যায় দখল আছে। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ঘটনাচক্রে, সেই সময়ই কলেজে গণিত নিয়ে পড়াশোনা করছেন কাজী আজিজুল হক।
খুলনার এক অখ্যাত গ্রাম থেকে ভাগ্যের ফেরে কলকাতায় এসে পৌঁছান আজিজুল হক। ছোটো বয়সেই বাবা-মা চলে যান। হতদরিদ্র অবস্থা; কিন্তু মেধা ছিল দেখবার মতো। অঙ্কের জটিল সমস্যার এক নিমেষে সমাধান করে ফেলতেন তিনি। কিন্তু সেভাবে পড়াশোনার সুযোগ পাননি। সেই কিশোর বয়সেই কলকাতায় এসে জায়গা পান এক বাবুর বাড়ি। এখানে এসে সহায় হন ভাগ্যদেবতা। নিজের মেধার জোরে আজিজুল হক জায়গা করে নেন প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে। সেখানেও সমস্ত অধ্যাপকদের নজর কেড়ে নেন তিনি।
কাজেই বেঙ্গল পুলিশের আইজি হেনরি সাহেব যখন অঙ্কে পারদর্শী এক তরুণের খোঁজে এলেন, তখন অবধারিতভাবে ডাক পড়ল কাজী আজিজুল হকের। সাব-ইনস্পেক্টর হিসেবে যুক্ত হলেন পুলিশ বিভাগে। আসল কাজ ছিল অপরাধী শনাক্তকরণের কাজটি আরও সহজ করার।
প্রায় একই সময় সাব-ইনস্পেক্টর পদে যুক্ত হয়েছিলেন হেমচন্দ্র বসু। আজিজুল এবং হেমচন্দ্র; দুজনে মিলে লেগে পড়লেন কাজে। সেই সময় অপরাধী শনাক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা হত একটি বিশেষ পদ্ধতি, নাম ‘অ্যানথ্রোপমেট্রি’। যেখানে মানুষের শরীরের আকৃতিকে ধরে কাজ করা হত। ব্যাপারটা যথেষ্ট জটিল। এদিকে, যেহেতু ততদিনে প্রমাণ হয়েও গেছে, যে কোনো দুজন মানুষের আঙুলের ছাপ হুবহু এক হয় না, তাই এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই শুরু হল আজিজুল-হেমচন্দ্রের কাজ।
পুরো বিষয়টির তত্ত্বাবধানে ছিলেন এডওয়ার্ড হেনরি। দুই তরুণের কাজ যথেষ্ট মুগ্ধ করেছিল তাকে। ১৮৯২ সালে পুলিশে যুক্ত হয়েছিলেন আজিজুল হক এবং হেমচন্দ্র বসু। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই দুজনে নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি। যার মূল কেন্দ্র ছিল ফিঙ্গারপ্রিন্ট। আজিজুল হক আবিষ্কার করলেন একটি বিশেষ গাণিতিক ফর্মুলা। আর তার ওপরই দাঁড়িয়ে থাকল পুরো সিস্টেম।
১৮৯৭ সালে বেঙ্গল পুলিশের বিশেষ কমিশন এই নতুন সিস্টেমের পরীক্ষা করেন। এবং, আশ্চর্য! অ্যানথ্রোপমেট্রির থেকে অনেক তাড়াতাড়ি, এবং অনেক নির্ভুল ফলাফল দিচ্ছে এই নতুন পদ্ধতি! শুধু বাংলা বা ভারত নয়, গোটা বিশ্ব চোখ ভরে দেখল এই আবিষ্কার। বলা ভালো, ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশনের শুরু সেই দিন থেকেই।
এরপরেই দেখা দিল বিতর্ক। না, পদ্ধতিটি নিয়ে নয়; তার নামকরণ নিয়ে। আইজি এডওয়ার্ড হেনরি কেবল তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আসল কাজ করেছিলেন কাজী আজিজুল হক এবং হেমচন্দ্র বসু। অথচ, নতুন আবিষ্কৃত পদ্ধতিটির নাম হয়ে গেল কিনা ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’!
এমনকি, গোটা বিশ্ব এই নামেই চিনল অপরাধ বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক আবিষ্কারকে! এই ঘটনা আজও অনেকে মানতে পারেন না। কাজী আজিজুল হকের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? না, জানা যায়নি। খারাপ কি লাগেনি একফোঁটাও? আজিজুল হকের অবদান কি ভুলে গেলেন স্বয়ং এডওয়ার্ড হেনরি?
তা হয়ত নয়। কারণ, পরবর্তী সময় হেনরি সাহেব বহুবার স্বীকার করেছেন আজিজুল হক আর হেমচন্দ্র বসুর অবদানের কথা। এই দুজন না থাকলে যে আঙুলের ছাপের এমন ব্যবহার সামনেই আসত না, সেটাও স্বীকার করেছেন। ১৯৩৫ সাল অবধি জীবিত ছিলেন আজিজুল হক। এবং ততদিন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে তার জায়গা ছিল যথেষ্ট সম্মানের। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবদানের জন্য তাঁকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিও দেওয়া হয়। হেমচন্দ্র বসু পান ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি। পরবর্তীকালে ব্রিটেনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিভিশন এই দুজনের নামে বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করেন। আজও যা ‘হক অ্যান্ড বোস অ্যাওয়ার্ড’ নামে বিখ্যাত। হেনরি সাহেবের সঙ্গে এক সারণিতে উচ্চারিত হন কাজী আজিজুল হক এবং হেমচন্দ্র বসু।
কিন্তু আমরা কি মনে রেখেছি এই দুজন কিংবদন্তিকে? আঙুলের ছাপ দিয়ে পৃথিবী বদলে দিয়েছিলেন যারা, তাদের কি আমরা যোগ্য সম্মান দিয়েছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ