এই দুর্মূল্যের বাজারে স্বল্প বেতনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অনেকেই আবার হতাশ হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন শিক্ষকতা।
শিক্ষকরা সবার শ্রেষ্ঠ, তাদের আদর্শ ধারণ করেই ছাত্ররা গড়ে ওঠে। এক সময় দেশ-সমাজ পরিচালনা করে তাদের ছাত্ররাই। কিন্তু সেই শিক্ষকরা এখন অর্থ সংকটে। যথাযথ সম্মান-মর্যাদা পাচ্ছেন না।
আবার সাম্প্রতিককালের কিছু কিছু ঘটনা এ ধারণাই দেয়—শিক্ষকদের কেউ কেউ মূল আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছেন। যার কারণে এখন শিক্ষকসমাজ সমালোচনার মুখে পড়েছে।
শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষকরা নানা বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা ঠিকমতো বেতন-ভাতা পান না। এ কারণে আর্থিক অনটনে দিন কাটে তাদের। অর্থের সঙ্গে সম্মান-মর্যাদা জড়িত। বেতন-ভাতা না পাওয়ায় সমাজের কাছে তাদের সম্মানহানি ঘটছে। মর্যাদা হারাচ্ছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকদের দিয়েই শিক্ষার রূপান্তর শুরু’। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত না হলেও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন এই দিবসটি নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে।
বেতন বৈষম্য
জানা যায়, সরকারি মজুরি বোর্ডের গ্রেড-১৩-এর অধীনে একজন সহকারী শিক্ষক মাসে বেতন পান মাত্র ১৭ হাজার ৫০০ টাকা; অন্যদিকে, একজন প্রধান শিক্ষক পান মাত্র ১৯ হাজার টাকা।
যদিও উভয় পদের জন্যই একজনকে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রী সম্পন্ন করতে হবে অথবা একটি অনার্স সার্টিফিকেট থাকতে হবে। অথচ কেবল হাই স্কুলের সার্টিফিকেট নিয়েও অন্যান্য পেশার বিভিন্ন পদের প্রারম্ভিক বেতন একই বা এরচেয়েও বেশি।
বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা মাসের সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পান, এই টাকার আবার ১০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয় অবসরকালীন সুবিধা জন্য।
সরকার অবশ্য সর্বশেষ ২০২০ সালে বেতন বাড়িয়েছিল; তবে সেখানে ইনক্রিমেন্ট ছিল মোটামুটি ১ হাজার টাকার মতো।
এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) তালিকাভুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন পিয়নদের বেতনের তুলনায়ও কম।
তিনি বলেন, “আমরা এখনও দেশে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। আমাদের সামাজিক মর্যাদা পর্যন্ত নেই। আমরা স্বচ্ছল নই। আমরা ক্ষুধার্ত থেকে কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেবো? সরকারের উচিত আমাদের প্রথম শ্রেণীর চাকরিজীবীদের মর্যাদা দেওয়া।”
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, সংগঠনটি বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছে বহুদিন, কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি বলেন, শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলে। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা না দেখিয়ে আমরা কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা আশা করতে পারি?
প্রতিশ্রুতিতেই আটকে আছে শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল চালু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তবে অজ্ঞাত কারণে তা কার্যকর হয়নি। টানা ১৪ বছর ধরে তা শুধু প্রতিশ্রুতিতেই আটকে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এ বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।
২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ‘সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সাল, কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ শীর্ষক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ‘শিক্ষা’ উপ-শিরোনামেও বিষয়টির উল্লেখ আছে।
আমরা এখনও দেশে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। আমাদের সামাজিক মর্যাদা পর্যন্ত নেই। আমরা স্বচ্ছল নই। আমরা ক্ষুধার্ত থেকে কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেবো?
এতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় :’২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়েছিল।
২০১৪ সালের ইশতেহারেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল প্রদান এবং স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। একই কথা বলা হয়েছে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতেও। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়, ‘আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।’ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে এভাবে পরিস্কার অঙ্গীকার থাকার পরও পৃথক স্কেলের কোনো খবর নেই।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিনেও সরকারের এ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় তারা হতাশ। শিক্ষকতা পেশায় নিম্ন বেতন ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে দেশের বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতা পেশায় নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে রাজি নন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় পদমর্যাদার সংকটের পাশাপাশি বেতনও কম। নিম্ন বেতন ও সামাজিক পদমর্যাদা শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকতা ছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষকতায় মেধাবীদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বেতনাদি নিয়ে ভোগান্তি
দেশে বেসরকারি কলেজে ৫ হাজার ৫০০ অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষক বিনা বেতনে প্রায় ৩০ বছর ধরে পাঠদান করে যাচ্ছেন। শিক্ষক নেতা নেকবর হোসাইন বলেন, আমাদের এমপিওর জন্য কত আলোচনা, দফায় দফায় কত বৈঠক হয়েছে। মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি, কত স্মারকলিপি, কত আশ্বাস। কিন্তু আমরা এখনো শূন্য হাতে।
এই শিক্ষকদের মতো নন-এমপিও স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থাও। বেতন-ভাতা না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাদের। দাবি আদায়ে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু অর্থসংকটের কথা বলে এমপিভুক্ত করা হয়নি তাদের। আবার জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়া প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরাও ভালো নেই।
বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মামুনুর রশিদ খোকন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেও কোনো ফল হয়নি। আবারও আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেতন না পাওয়ার কষ্ট আর সইতে পারছি না। সমাজে অনেক ‘ছোট’ হয়ে আছি।
একদিকে বেতন-ভাতা না পেয়ে সমাজের কাছে ছোট হয়ে আছেন, অন্যদিকে বেতন পাওয়া শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষক সমাজের মর্যাদাকে কলুষিত করছেন।
প্রশ্ন ফাঁস-নকল সরবরাহ, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। শিক্ষক নেতারা বিষয়টিকে ‘শিক্ষক সমাজের অবক্ষয়’ হিসেবে দেখছেন।
চলতি বছরের জুন মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক প্রতিবেদনে দেশে ১ হাজার ১০৮ জন শিক্ষক পাওয়া গেছে, যারা অবৈধভাবে নিয়েছেন সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। তারা জাল সনদে চাকরি করছেন বছরের পর বছর ধরে।
শিক্ষকদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও কম নয়। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষরাই এটি করে থাকেন। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে তদন্তে এমন কয়েক হাজার শিক্ষকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।
ক্লাসে মনোযোগী করার জন্য কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা জারি করে সরকার। কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাসের পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে প্রাইভেট-টিউশনি-কোচিংমুখী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে অবক্ষয় হয়েছে। শিক্ষকরাও এর বাইরে নন।
তারা বলেন, শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা কম। এ কারণে শিক্ষকরা অর্থের জন্য এদিন-ওদিক ছোটাছুটি করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষার সামগ্রিক বাজেট বাড়াতে হবে। প্রকৃত মেধাবীদের এ পেশায় আনতে বেতন ও পদমর্যাদা বাড়াতে হবে।
তারা বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব কাটাতে নিম্ন মেধার লোকজনও শিক্ষকতায় ঢুকে পড়েছে। জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশ এতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ