মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশ থেকে লাখো মানুষের স্রোত ধাঁই করেছে ইউরোপের দিকে। প্রত্যাশা একটাই—একটুখানি আশ্রয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে।
প্রাণ বাঁচাতে, জীবিকা খুঁজে নিতে ছুটছে এসব মানুষ। ছুটন্ত এসব অভিবাসন-প্রত্যাশীর দেশগুলোতে চলছে সংঘাত, অস্থিরতা, নিপীড়ন, বঞ্চনা। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ তাদের জীবন। টিকে থাকার মৌলিক চাহিদার জন্য ব্যাকুল তারা। চাই খাদ্য, নিরাপত্তা আর আশ্রয়।
এদিকে জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চেভেলের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ইউরোপের দেশগুলো থেকে আবার ফেরানো হচ্ছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের। ইউরোস্ট্যাট’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ সদস্য দেশ থেকে প্রায় এক লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সোমবার প্রকাশ করা ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান আরো জানাচ্ছে, ওই চার মাসে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ জারির হারও আগের তুলনায় বেড়েছে।
মে থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ইউরোপের বাইরে থেকে আসা মোট ৯৬ হাজার ৫৫০ জনকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ হাজার ১১০ জনকে ইতোমধ্যে নিজের দেশ, অথবা ইউরোপের অন্য একটি দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ২০২১ সালে ওই চার মাসে এর চেয়ে শতকরা ১৫ ভাগ কম মানুষকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ফেরত পাঠানো মানুষের সংখ্যা তখন চলতি বছরের তুলনায় ১১ ভাগ কম ছিল।
কোন দেশ থেকে কতজন
চলতি বছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিজ নিজ দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে ফ্রান্স। মোট ৩৩ হাজার ৪৫০ জনকে এ নির্দেশ দিয়েছে তারা। ফ্রান্সের পরে রয়েছে যথাক্রমে গ্রিস (৮ হাজার ৭৫০ জন), জার্মানি (৮ হাজার ২৭৫ জন) এবং ইতালি (৬ হাজার ২০ জন)। এ সময়ে ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ৩ হাজার ৫৯০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী। জার্মানি থেকেও ওই চার মাসে ২ হাজার ৭৬৫ এবং গ্রিস থেকে ১ হাজার ৭৭০ জনকে ফিরে যেতে হয়েছে।
২০২০ সাল, অর্থাৎ করোনা মহামারী শুরুর বছরের মে থেকে আগস্টের মধ্যে মাত্র ৭৬০ জনকে দেশে ফিরিয়েছিল জার্মানি। তবে তার আগের বছর একই সময়কালে ফেরানো হয়েছিল ৯ হাজার ৯২০ জনকে।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ইউরোপ থেকে সবচেয়ে বেশি ফেরানো হয়েছে আলবেনীয়দের। তাদের পর রয়েছে যথাক্রমে জর্জিয়া, রাশিয়া ও তুরস্কের নাগরিকরা।
চলতি বছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ সদস্য দেশ থেকে প্রায় এক লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে! ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটে থাকা ২৭ রাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থীর হার ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ ৪৮ হাজার আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপের দেশগুলোতে আবেদন করেছেন। শীর্ষ ছয় আবেদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম!
গত ২৮জুন প্রকাশিত আশ্রয়প্রার্থী বিষয়ক ইইউ’র বার্ষিক রিপোর্টে বিস্তারিত ওঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আবেদনকারীর হার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের দিকে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মানুষের আবেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় এই সংখ্যা হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আশ্রয়প্রার্থীর আবদনের তালিকার শীর্ষ রয়েছে সিরিয়া। সে দেশ থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার মানুষ আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। সিরিয়া ছাড়া শীর্ষ ছয় দেশের তালিকায় রয়েছে—আফগানিস্তান (১ লাখ ২ হাজার), ইরাক (৩০ হাজার), পাকিস্তান ও তুরস্ক (২৫ হাজার করে) এবং বাংলাদেশ (২০ হাজার)।
অভিবাসী থামানোর পরিকল্পনা বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যেসব অভিবাসী বৃটেনে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তা থামানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন বৃটেনের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান। এক্ষেত্রে নতুন করে একটি নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন তিনি।
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বৃটেনে প্রবেশের পরই এসব অভিবাসী আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এরই মধ্যে ছোট ছোট বোটে করে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ সেখানে প্রবেশ করেছেন। তবে যেসব অভিবাসী বৃটেনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবেন তাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবেন তিনি। যারা বেআইনিভাবে বৃটেনে প্রবেশ করেন এর মাধ্যমে তাদের আইন লঙ্ঘনের ইতি ঘটানোর প্রত্যয় ঘোষণা করেন তিনি।
মঙ্গলবার কনজার্ভেটিভ পার্টির কর্মীদের কনফারেন্সে বক্তব্যে এসব প্রতিশ্রুতি দেন সুয়েলা ব্রেভারম্যান। যারা বৃটেনে বেআইনিভাবে প্রবেশ করবে তাদেরকে বিচারের আওতায় নেয়ার কথা বলেন তিনি।
লন্ডনের টাইমস পত্রিকার মতে, বেআইনি অভিবাসন বিষয়ে একটি বিল প্রস্তাব করার কথা রয়েছে সুয়েলা ব্রেভারম্যানের। এতে বলা হয়েছে, এই বিলে বেআইনিভাবে বৃটেনে কেউ প্রবেশ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হবে।
বিশেষ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বৃটেনে যান এবং আশ্রয় প্রার্থনা করেন তাদেরকে থামাতে চান তিনি।
সোমবার সরকার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এরই মধ্যে ছোট ছোট বোটে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে কমপক্ষে ৩৩ হাজার অভিবাসী।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ডাটায় দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে বিপজ্জনকভাবে ২১ মাইল চওড়া ডোভার প্রণালী পাড়ি দিয়েছে কমপক্ষে ৩৩ হাজার ১ জন। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরে গিয়েছে মোট ৭৯৬১ জন অভিবাসী। সোমবার আরও ৪০০ মানুষ ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছে। ফলে এসব সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।
বর্ডার ফোর্সের কমপক্ষে দুটি যান ডোভার, কেন্টে মঙ্গলবার সকালের শুরুতে কয়েক ডজন অভিবাসীকে ঘেরাও করেছে। ওই অভিবাসীদের মধ্যে আছে টিনেজাররা। কড়া ঠাণ্ডায় তাদের গায়ে শুধু কম্বল জড়ানো। তারা সাবেক একটি জেটফয়েল টার্মিনালের ডকসাইটে লুকিয়ে ছিল, যাতে কেউ তাদের দেখতে না পায়।
অন্যদিকে সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের রোয়ান্ডা পাঠিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে ওয়ান-ওয়ে ট্রিপ। অর্থাৎ তাদের ফেরার কোনো সুযোগ রাখা হচ্ছে না। কিন্তু সরকারি সেই সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে মিসেস সুয়েলা ব্রেভারম্যান কি করেন তা দেখার। তিনি হয়তো এটা নিশ্চিত করবেন যে, বৃটেনের বেআইনি অভিবাসন বিষয়ক নীতিকে আধুনিক দাসত্বের আইন দ্বারা, মানবাধিকারের আইন দ্বারা অথবা ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস দ্বারা পথচ্যুত করা যাবে না।
বার্মিংহামের কনফারেন্সে সুয়েলা ব্রেভারম্যান বলেন, এটা ঠিক যে, যাদেরকে আমাদের প্রকৃতপক্ষেই প্রয়োজন, তাদের বিষয়ে আমাদেরকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে হবে। বৃটেন সব সময়ই তা করে এসেছে। এটাই করেছিলেন আমার পিতা। তিনি ১৯৬০ এর দশকে একজন যুবক হিসেবে কেনিয়া থেকে বৃটেনে এসেছিলেন। কিন্তু এখন আমরা সিরিয়া, হংকং, আফগানিস্তান এবং ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছি।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউরোপের অভিবাসী সংকটের মূলে রয়েছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও ইয়েমেনের মত সংকটাপন্ন দেশগুলো। তাই যতদিন এইসব দেশের গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত না হবে ততদিন অভিবাসী সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোও যথেষ্ট সংখ্যাক অভিবাসী তৈরির জন্য দায়ী।
অফ্রিকায় সম্পদের কমতি না থাকলেও রাজনৈতিক অস্থীতিশীলতা, দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন এ অঞ্চল থেকে উল্লেখজনক হারে শরণার্থী তৈরি করছে। তাই অভিবাসী সংকট মোকাবেলায় আফ্রিকার উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে প্রয়োজন শরণার্থী দেশগুলোর প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের আন্তরিক মনোভাব।
সিরিয়া কিংবা ইয়েমেনের অভিবাসীরা গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য ধনী দেশগুলোকে বেছে না নিয়ে দূর দুরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে বেছে নিচ্ছে ইউরোপকে। এর কারণ পার্শ্ববর্তী ধনী দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না। আশ্রয় না দেয়ার কারণ হলো তারা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে সাক্ষর করেনি। ফলে তারা বাধ্য নয় শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা সৌদি আরবের মত দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এই শরণার্থীর দুর্দশা হয়ত কিছুটা হলেও লাঘব হত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৮
আপনার মতামত জানানঃ