গ্রাহকদের টাকা নিয়ে প্রতারণা করার উদ্দেশেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির জন্ম হয়েছিল। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও ডিসকাউন্টের চাকচিক্যে কোনরকম আইন না মেনেই গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ইভ্যালি।
ইভ্যালিকে নিয়ে অডিট রিপোর্ট এবং আদালতের নির্দেশে গঠিত পরিচালনা বোর্ডের প্রতিবেদনে এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
এসব রিপোর্টে কোম্পানিটির দুরবস্থার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলকে দায়ী করা হয়েছে। একইসঙ্গে জানানো হয়েছে, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেনের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, এই টাকাগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে।’
ইভ্যালি বাংলাদেশ ভিত্তিক একটি ই-কমার্স প্লাটফর্ম। ক্যাশব্যাকের অফার দেওয়ার ক্ষেত্রে ইভ্যালির নাম উঠে আসে সবার আগে। লোভনীয় ডিসকাউন্টের ছিল ছড়াছড়ি। অল্প সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের ভোগান্তি শেষ সীমানায় পৌঁছেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। আর মোহাম্মদ রাসেল এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। মো. রাসেল ইভ্যালির সিইও, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন।
বর্তমান হিসেবে ‘ইভ্যালি’ প্রায় ১৭ লাখ নিয়মিত ক্রেতা, ২০ হাজারের বেশি বিক্রেতা। এদের নিয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে স্বল্প সময়ে প্রথম সারিতে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রিধারী মোহাম্মদ রাসেল হচ্ছেন ই-ভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা। কর্মজীবন শুরু করেন তিনি ঢাকা ব্যাংক দিয়ে। পরে ছেড়ে দিয়ে ‘কিডস’ ব্র্যান্ডের ডায়াপার আমদানি শুরু করেন। পরে নিয়ে আসেন ই-ভ্যালি। শুরুর দিকে চালু করা হয় ‘ভাউচার’ নামক একটি পদ্ধতি, এতে দেওয়া হতো ৩০০ শতাংশ ও ২০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক। বর্তমানে ১৫০ শতাংশ, ১০০ শতাংশ এবং পরে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শুরুর দিকে ১০ টাকায় একটি পেনড্রাইভ এবং ১৬ টাকায় টি-শার্ট বিক্রি করে সাড়া জাগায় ই-ভ্যালি।
মূলত ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইভ্যালিতে অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করা নিয়ে গ্রাহকদের মনে সন্দেহ দানাবাঁধতে থাকে। এক পর্যায়ে মোটরসাইকেল-ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিনসহ বেশকিছু দামি পণ্য সরবরাহ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউজে গ্রাহকরা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাদের মধ্যে আরিফ বাকের এমনই একজন গ্রাহক। গুলশান থানায় অর্থ আত্মসাৎ ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে তিনি মামলা করেন। ওই মামলায় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসায় অভিযান পরিচালনা শেষে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেনের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, এই টাকাগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে।
প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের টাকা নিয়ে প্রতারণা করার উদ্দেশেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির জন্ম হয়েছিল। ইভ্যালি ছিল এক পরিবারের কোম্পানি এবং একক ব্যক্তির নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটি চলতো। এই প্রতিষ্ঠানে মোহাম্মদ রাসেলই একাধারে এমডি, সিইও, সিএফও, প্রধান হিসাব রক্ষকসহ সব দায়িত্ব পালন করতেন। ব্যবসা পরিচালনায় কোম্পানিটি কোনও আইন ও বিধি মানেনি। সবক্ষেত্রেই ছিল গোঁজামিল। অনেক ভাউচার পাওয়া গেলেও দাতা-গ্রহীতার কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। ফলে কোম্পানির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছিল, কোম্পানি চালানো সম্ভব না হলে দেউলিয়া করে দেয়া, কিন্তু পরিচালনা বোর্ডের মতে, লাখ লাখ গ্রাহকের ভাগ্য ও পুঁজি এই কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তাই দেউলিয়া ঘোষণা না করাই সমীচীন। এর ফলে ইভ্যালি ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে চালুর হওয়ার পথ খোলা থাকবে। ২০২১ সালের ১ জুলাইয়ের আগে সকল গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ কিংবা তাদের চাহিদা মতো পণ্য ডেলিভারিসহ ব্যবসা বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত সকল মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করা প্রয়োজন। সাভারে অবস্থিত ইত্যাদির ৪টি গোডাউনে বাজার মূল্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে। যার বেশিরভাগই হচ্ছে ইলেক্ট্রনিকস পণ্য সামগ্রী। এগুলো এভাবে পড়ে থাকলে প্রায় সবগুলো পণ্য নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরমধ্যেই পচনশীল সব দ্রব্যের মেয়াদ পার হয়ে গিয়েছে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ইভ্যালির লেনদেনসহ সার্বিক তথ্য তুলে আনতে কোম্পানিটির অডিট প্রতিবেদনে বেশ কিছু অনিয়মের তথ্য ওঠে এসেছে। সেই রিপোর্টের আলোকে বিদায়ী পরিচালনা পর্ষদের পর্যবেক্ষণ ছিলো এমন—‘অডিট রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্যাবলী এবং কাগজপত্রের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এইভাবে ব্যবসা পুনরায় চালানো অসম্ভব, যদি সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে দূর করে ব্যবসা চালানো না হয়। ইভ্যালির বিশাল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কোনও স্তরেই কোনও প্রকার জবাবদিহি বা স্বচ্ছতা ছিল না। যেটা একটা সফল ম্যানেজমেন্টের মূল স্তম্ভ। অডিট রিপোর্টে কোম্পানির আর্থিক অবস্থান চিহ্নিত করার মতো কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি বা ইভ্যালির প্রাক্তন ম্যানেজমেন্ট তা মেইনটেইন করেনি।
অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে, হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেনের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, এই টাকাগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে। যা ছিল এই কোম্পানির সবচেয়ে বড় অনিয়ম।’
জানা গেছে, ইভ্যালির রাসেল ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ২০১১ সালে ঢাকা ব্যাংকে চাকরি নেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করেন রাসেল। ৬ বছর পর ঢাকা ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার ব্যবসা শুরু করেন।
ইভ্যালি মোটরসাইকেল, গাড়ি, মোবাইল ফোন, ঘরের সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রের মতো ইত্যাদি উচ্চমূল্যের পণ্যে লোভনীয় ছাড় দেয়। প্রতিষ্ঠার শুরুতে ‘সাইক্লোন’ (ঘূর্ণিঝড়), আর্থকুয়েক’ (ভূমিকম্প) ইত্যাদি নামে তারা ক্রেতাদের ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ ক্যাশব্যাকের মতো অত্যন্ত লোভনীয় অফার দেয়। তাদের ব্যবসার এই কৌশলের ফলে মানুষের মাঝে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তবে সেই সাইক্লোন বেশিদিন স্থায়ী থাকেনি।
২০১৬ সালে প্রথমে অনলাইনে ডায়াপার বিক্রি দিয়ে যাত্রা শুরু করেন রাসেল। ২০১৭ সালে এই ব্যবসা করতে গিয়ে বড় একটি অনলাইন প্লাটফর্মের কথা চিন্তা করেন তিনি। সেই চিন্তা থেকেই প্রতিষ্ঠা করেন দেশীয় ই-কমার্স কোম্পানি ‘ইভ্যালি’। প্রায় ১৭ লাখ নিয়মিত ক্রেতা, ২০ হাজারের বেশি বিক্রেতা নিয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে স্বল্প সময়ে প্রথম সারিতে উঠে আসে ‘ইভ্যালি’।
এশিয়ার মধ্যে স্বল্প সময়ে দ্রুতবর্ধনশীল ই-কমার্স স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ও বিজনেস লিডার হিসেবে অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন মোহাম্মদ রাসেল।
ইভ্যালির ‘সম্পদের চেয়ে ছয় গুণ বেশি দেনা’ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে উঠে আসে ইভ্যালির মোট দায় ৪০৭ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছে ২১৪ কোটি টাকা, আর মার্চেন্টদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নিয়েছে ১৯০ কোটি টাকার। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কমপক্ষে ৪০৪ কোটি টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা। কিন্তু সম্পদ আছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকার।
এছাড়া গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালির নেওয়া অগ্রিম ৩৩৯ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ টাকা আত্মসাৎ বা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-কমার্সে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো গ্রাহকের আস্থা। তা রক্ষা করা না গেলে তাতে দু-একটি প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা শিল্পের ওপরই মানুষ আস্থা হারাবে। সে জন্য যেসব অভিযোগ আসছে, প্রশাসনিকভাবেই সেগুলো দ্রুত খতিয়ে দেখা দরকার। কেবল ভোক্তার স্বার্থেই নয়, বরং ই-কমার্স খাতের শৃঙ্খলা আনয়নে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দু-একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা কারও কাম্য নয়। ভোক্তা যাতে প্রতারিত না হন, বাজারে যাতে প্রতিযোগিতা থাকে বা সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ থাকে, সে জন্য এ খাতে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা যথাযথ পরিচালন নীতিমালার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৪
আপনার মতামত জানানঃ