নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে ‘ভ্রান্ত’ ধারণা দূর করতে ব্যাপক প্রচারণায় যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রেডিও, টেলিভিশন ছাড়াও মসজিদ-মন্দিরেও প্রচারণা চালানো হবে।
ইসি সচিব বলেন, ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল রাকিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে টিভিসি করার জন্যে। জনগণ যাতে ইভিএম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পায় এবং কীভাবে ভোট দেবে এটি প্রচারিত হয় এ জন্য তারা কাজ করবেন। অল্প সময়ের মধ্যে কমিশনকে তারা কর্মপরিকল্পনা দেখাবেন। তারপর এটি আমরা প্রচারের ব্যবস্থা করবো।
তিনি বলেন, অনেক কিছু থাকবে। টিভিসি ছাড়াও পত্র-পত্রিকা, মসজিদ-মন্দিরে আমাদের যে প্রচারণা সেটি থাকবে। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের প্রচারণা থাকবে। বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা থাকবে। এটি একটি সমন্বিত কর্মসূচি। এখন যে দায়িত্বটা দিয়েছি সেটি হলো আমাদের টিভিতে, বিভিন্ন চ্যানেলে, বিটিভিতে, আমাদের ফেসবুকে, সব জায়গায় প্রচার করার জন্য।
ইসি সচিব বলেন, ইভিএমের কোন বাটনে চাপ দেবেন সেটার সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হবে এতে। অনেকের এ ধারণা থাকে যে আমি কলা মার্কায় ভোট দিতে চাই, কিন্তু টিপ দেওয়া হলো আম মার্কায়। এরকম ভুল যেন না হয় এবং এ ধারণাগুলো দূর করার জন্য যতগুলো ডাউট আছে সেগুলো প্রশ্নাবলী আকারে করে একটা টিভিসির মতো করা হবে। এটা করে আমরা প্রচার করবো। এ কাজটি ইভিএমের যিনি পিডি তাকে দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রস্তুত করে কমিশনকে দেখাবেন। কমিশন এটি দেখে সন্তুষ্ট হলে আমরা প্রচার করবো।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে চায় নির্বাচন কমিশন। এজন্য নতুন একটি প্রকল্পও হাতে নিচ্ছে সংস্থাটি। নির্বাচনে ভোটারদের সন্দেহ দূর করতে এবং ইভিএমে ভোটদান পদ্ধতির ধারণা পরিষ্কার করতে চালানো হবে প্রচরণাও, যা এতে বড় পরিসরে আগে কখনো করেনি কমিশন।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দুই লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্পের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের লক্ষ নির্ধারণ করে এই প্রকল্পের আওতায় দুই লাখ ইভিএম মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। কমবেশি ২ হাজার ৪০০ ডলার হিসেবে প্রতিটি ইভিএম মেশিন কেনা হবে বলে জানিয়েছে ইসি সচিবালয়। আরো আনুষাঙ্গিক খরচসহ যেটা বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আড়াই লাখ টাকার মেশিন প্রতি খরচ হবে। দুই লাখ মেশিন কিনতেই খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্পসহ ইসির ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। গত নির্বাচনে প্রতিটি ইভিএম মেশিন সবমিলিয়ে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা দরে কেনা হয়। প্রকল্প নেয়ার সময় বলা হয়েছিল এগুলো ১৫ বছরের বেশি টেকসই হবে। কিন্তু পাঁচ বছর না যেতেই প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ ইভিএম মেশিনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ইসির সংলাপে ২৯টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। এর মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আরও পাঁচটি দল ইভিএম নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের কথা বলেছে। কেবল আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে।
বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে। গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ইসির সংলাপে ২৯টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। এর মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আরও পাঁচটি দল ইভিএম নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের কথা বলেছে। কেবল আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। সবার মত উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশন মনে করে ইভিএমেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, কমিশনের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব, যা জাতি হিসেবে আমাদেরকে চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে।
কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার একটি কারণ হলো যে, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি পুনঃগণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি।
তারা বলেন, প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা যায়। বায়োমেট্রিক্সভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না, ফলে কমিশন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদেরকে তাদের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেওয়ার তথা ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে। যে কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফলাফল নিয়েও কারসাজি করা যায়। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কারিগরি টিমও নির্বাচনী ফলাফল বদলে দিতে পারেন। গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুইবার ফলাফল প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে, যা কেবল ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই সম্ভব। এছাড়াও আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, ইভিএম ব্যবহার করার কারণে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
তারা মনে করেন, ইভিএম ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের যে আস্থাহীনতা তা দূর না করেই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হবে ও আরেকটি অনাকাক্ষিত বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করবে। তাই আমরা নিম্নলিখিত স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিবর্গ আমাদের নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ