বিশ্বের বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীত আর্কটিক উলফকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় দারুণ সাফল্য মিলেছে। ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে নতুন নেকড়ে শাবক তৈরি করেছে চীন। মনে করা হচ্ছে, এই পদ্ধতি আগামী দিনে আর্কটিক নেকড়েকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। চীনা ল্যাবে প্রথমবারের মতো আর্কটিক নেকড়েদের ক্লোনিং করে একটি নতুন নেকড়ে তৈরি করা হয়েছে। যদিও এই নেকড়েটির বয়স এখন ১০৬ দিন।
আর্কটিক নেকড়েটির জন্য সারোগেট হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল একটি কুকুরকে। কারণ কুকুরদের সঙ্গে নেকড়েদের পূর্বপুরুষদের জেনেটিকে মিল পাওয়া গেছে, তাই এই ক্লোনিং কৌশলের মাধ্যমে পরীক্ষাটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মায়া নামের এই নেকড়ের ক্লোন তৈরি করেছে চীনের সংস্থা সিনোজিন বায়োটেকনোলজি। এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম ইউরো নিউজ।
World’s 1st cloned wild arctic wolf makes its debut via video, 100 days after its birth in a Beijing lab. Its birth is believed to pioneer breeding of more rare and endangered animals through cloning technology. https://t.co/tLTsNc8wEH pic.twitter.com/iYcqnOEnOq
— Global Times (@globaltimesnews) September 19, 2022
এই নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে, কোম্পানির ম্যানেজার মি জিডং বলেছেন যে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য, আমরা হারবিন পোলারল্যান্ডের সহযোগিতায় ২০২০ সালে আর্কটিক নেকড়ের ক্লোনিং শুরু করেছি। দুই বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর এখন এই ক্লোনিং সফল হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বে এই ধরনের প্রথম ঘটনা এটি। আর্কটিক নেকড়েদের ক্লোনিং ক্লোনিং প্রযুক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে প্রমাণিত হবে কারণ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া এই ধরনের প্রজাতিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এই আর্কটিক নেকড়েটি এই বছরের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেছিল। মায়া নামের এই নেকড়ে শাবকটি এই মুহূর্তে সুস্থ আছে।
চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমসে’র সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন নয়, মায়ার জন্ম হয়েছে তিন মাসেরও বেশি সময় আগে। তবে তার জন্মের ১০৬ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সে সুস্থ আছে, তা দেখার পরেই পুরো বিষয়টি প্রকাশ্যে আনা হল।
এই সাফল্যের পর প্রতিষ্ঠানটির আধিকারিক ও বিজ্ঞানীরা জানান, ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের বিরল ও বিলুপ্তির পথে থাকা প্রাণীগুলিকে বাঁচাতে পারব।
সূত্র মতে, মেরুপ্রদেশের বন্য এক স্ত্রী নেকড়ের ডিম্বাণু থেকে মায়ার জন্ম হলেও তার ভ্রূণটি প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল একটি বিগল প্রজাতির কুকুরের গর্ভে।
সিনোজিন বায়োটেকনোলজির কর্ণধার জানান, বিপণ্ণ পশুদের বাঁচাতেই এই ধরনের পরিকল্পনা করা হয়। ২০২০ সাল থেকেই মেরুপ্রদেশের নেকড়ের ক্লোনিং করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ দুই বছরের নিরলস প্রচেষ্টার পরে সাফল্য এল।
বিশ্বে এই প্রথম এই ধরনের ক্লোনিংয়ে সাফল্য এলো বলে দাবি করেন তিনি। মায়া এখন উত্তর চীনের হেইলংগিয়াং প্রদেশের এক ল্যাবে তার ‘জন্মদাত্রী’ মা কুকুরের সঙ্গেই রয়েছে।
আর্কটিক নেকড়ের ক্লোনিং একটি মহিলা কুকুরের সংযোজিত ডিম্বাণু এবং একটি বন্য মহিলা আর্কটিক নেকড়ের সোম্যাটিক কোষ থেকে ১৩০ টিরও বেশি নতুন ভ্রূণ তৈরি করে সম্পন্ন হয়েছিল। ৮০ টিরও বেশি ভ্রূণ তখন সাতটি বিগলের জরায়ুতে স্থানান্তরিত হয়েছিল, যার মধ্যে একটি সুস্থ নেকড়ে হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিল।
জানা যায়, যেহেতু বুনো নেকড়ে থেকেই কুকুরের উৎপত্তি, তাই এই সিদ্ধান্ত। তাছাড়া নেকড়ে ও কুকুরের জিনগত সাদৃশ্যের কথাও মাথায় রাখা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ক্লোন করা বন্য নেকড়ে মায়া এখন তার সারোগেট বিগলের সাথে একটি পরীক্ষাগারে রয়েছে এবং পরে উত্তর-পূর্ব চীনের হেইলংজিয়াং প্রদেশের হারবিন পোলারল্যান্ডে তাকে পৌঁছে দেওয়া হবে এবং জনসাধারণের সামনে প্রদর্শন করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্লোনিং প্রযুক্তি আরও বিরল ও বিপন্ন প্রাণীদের প্রজননে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
বিজ্ঞানীরা মায়ার জন্মকে ঘিরে আশাবাদী। ভবিষ্যতে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বাঁচাতে এই ধরনের ক্লোনিং বিপুল সাহায্য করবে বলেই মনে করছে বিজ্ঞানী মহল।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে এক স্কটিশ বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে জন্ম নিয়েছিল প্রথম ক্লোন করা প্রাণী ডলি। সেই ভেড়ার জন্মের পর কেটে গিয়েছে প্রায় তিন দশক। ইতিমধ্যেই ক্লোনিং নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে পৃথিবী। যার অন্যতম নিদর্শন মায়া। যা এই সংক্রান্ত গবেষণাকে ভবিষ্যতে আরও বড় সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই ধারণা বিজ্ঞানিদের।
মূলত পৃথিবীতে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দেড়শো প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে৷ জীববৈচিত্র্যের এমন ভয়াবহ অবক্ষয় রুখতে বিজ্ঞানীরা ক্লোনিং-সহ নানা প্রযুক্তি প্রয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছেন৷
নির্দিষ্ট ক্লোনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন জিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যা বাস্তবে লুপ্ত হয়ে যেতো৷ এভাবে জিন পুল আরও শক্তিশালী করে তোলা যায়৷
এর মাধ্যমে কোনো লুপ্রপ্রায় প্রজাতির আন্তঃপ্রজনন ও রোগব্যাধীর মতো ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে৷ ক্লোনিং এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও সহায়তা করতে পারে৷
কমে চলা জীববৈচিত্র্য আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলছে৷ এর ফলে পরাগায়ন প্রক্রিয়া এবং খাদ্য ও পানির মতো মৌলিক সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে৷ বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলি এর ফলে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
একের পর এক প্রজাতি নাটকীয় হারে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে জীববৈচিত্র্য প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে৷ বর্তমানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দেড়শো প্রজাতি চিরকালের জন্য উধাও হয়ে যাচ্ছে৷
গোটা বিশ্বের গবেষকরা আরও সচেতন হয়ে গবেষণাগার, চিড়িয়াখানা ও জিন ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব জিনের উপাদান সংগ্রহ করছেন৷ ‘ফ্রোজেন আর্ক’ উদ্যোগের প্রতিনিধি এড লুইস বলেন, ‘‘হাতে আর সময় নেই৷ আমি নিশ্চিত, যে অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব এখনই আর রক্ষা করা সম্ভব নয়৷ পুরোপুরি বিলুপ্ত হবার আগে ডিএনএ সংরক্ষণ শেষ উপায়৷ এভাবে কমপক্ষে জিনগত উত্তরাধিকার হাতে রাখা সম্ভব৷’’
এড লুইস ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম ও চিড়িয়াখানা পরিচালিত এক জিন ব্যাংকের সহ প্রতিষ্ঠাতা৷ এই সংগঠন এখনো পর্যন্ত ৪৮ হাজারেরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছে৷
ক্লোনিংয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনো পর্যন্ত মূলত অ্যামেরিকার মতো পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশে ঘটলেও গোটা বিশ্বের অনেক দেশের সরকারও ডিএনএ ভাণ্ডার বাড়িয়ে চলেছে৷
ভারত, চীন থেকে শুরু করে অ্যামাজন অঞ্চলে গবেষকরা লুপ্তপ্রায় প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করে চলেছেন৷ প্রযুক্তির সাহায্যে অবস্থার উন্নতির চেষ্টা চলছে৷ ‘ফ্রোজেন আর্ক’ উদ্যোগের প্রতিনিধি এড লুইস বলেন, কমপক্ষে এই সব তথ্য পেলেও সুবিধা হয় বৈকি৷ একটি প্রজাতি বাঁচানো গেলেও পরিশ্রম সার্থক৷
ক্লোনিং আসলে কৃত্রিম প্রজননের একটি অংশমাত্র৷ ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মতো বিকল্প গর্ভধারণ পদ্ধতি এবং সম্প্রতি ‘জিন এডিটিং’-এর মতো প্রক্রিয়াও এর অংশ হয়ে পড়েছে৷
গোটা বিশ্বে প্রায় এক হাজার চিড়িয়াখানা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বন্য প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে কাজ করছে৷ এর মধ্যে চারটি প্রকল্পের আওতায় ক্লোনিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ চলছে৷
জিনগত বৈচিত্র্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা পুরোদমে চলছে৷ ক্লোনিং পদ্ধতির মাধ্যমে কিছু প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করা অবশ্যই সম্ভব হবে৷ তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতির বিশাল ব্যয় এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অজানা থাকার কারণে অবশিষ্ট প্রজাতিগুলির অস্তিত্ব রক্ষা করা অনেক বেশি কার্যকর হবে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ