একটা তীব্র বিস্ফোরণ। কয়েক সেকেন্ডে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু! শরীর থেকে খসে পড়ছে মাংস। জ্বলছে হাত-পা। ঠিক এমনটাই হয়েছিল ১৯৪৫ সালের অগাস্টে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু হামলা চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল কাতারে কাতারে মানুষের। বোমার তেজস্ক্রিয়তা তার কয়েক বছর পরেও ছিল।
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে ফের পরমাণু যুদ্ধের ভ্রূকূটি। যদিও যুদ্ধ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে তা সত্ত্বেও পরমাণু যুদ্ধে বিপদ কমেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমী বিশ্ব পাশে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনের। তবে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি তারা। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বহিরাগত কেউ যুদ্ধে জড়ালে ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞদের মতে, পরমাণু বোমা হামলার ইঙ্গিতই দিয়েছেন পুতিন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, রাশিয়ার ‘ভূখণ্ডের অখণ্ডতা’ হুমকির মুখে পড়লে- তিনি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে পিছপা হবেন না। পুতিন বলেছেন, এটা নেহাত ফাঁপাবুলি নয়– রাশিয়া তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে যেকোনো উপায় গ্রহণ করবে।
গত বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) পুতিনের দেওয়া এ ভাষণের পর থেকেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পশ্চিমা দেশগুলির নীতিনির্ধারকদের কপালে। বুধবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো রুশ রিজার্ভের একটি অংশকে তলব করার সময় তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন।
কিয়েভকে অর্থ, অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য, প্রশিক্ষণ–সর্বোপরি সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র)। পুতিনের হুমকিও তাদের প্রতি।
তাই কীভাবে রাশিয়া তার পারমাণবিক নখরের আঘাত হানতে পারে– সে বিষয়ে নীরবে চলছে সরকারগুলির উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা।
বেশিরভাগ বিশ্লেষক অবশ্য বিশ্বাস করেন না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার পর রাশিয়া বর্তমান সময়ে গণবিধ্বংসী এ অস্ত্রের ব্যবহার করবে। যেহেতু তাতে পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি আছে শতভাগ।
তবে বার্তাসংস্থা এএফপি’কে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা— রাশিয়া কোন ধরনের পরিস্থিতিতে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, সে সম্পর্কে তাদের ধারণা জানিয়েছেন।
কেমন হবে রুশ পরমাণু হামলা?
ধ্বংসশক্তি ও উদ্দেশ্যসাধনের দিক থেকে পরমাণু ওয়ারহেডকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়– ‘ট্যাকটিক্যাল’ ও ‘স্ট্র্যাটেজিক’।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, রাশিয়া ‘ট্যাকটিক্যাল’ বা প্রচলিত যুদ্ধে বিশেষ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন– এমন একটি বা দুটি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
এসব ‘ট্যাকটিক্যাল নিউক’ আকারে খুবই ছোট হওয়ায়, ধ্বংসক্ষমতা ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অস্ত্রের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। সাধারণত এদের বিস্ফোরক ক্ষমতা শূন্য দশমিক ৩ কিলোটন থেকে ১০০ কিলোটন পর্যন্ত হতে পারে।
সে তুলনায়, আমেরিকার সবচেয়ে বড় স্ট্র্যাটেজিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের বিস্ফোরক ক্ষমতা ১.২ মেগাটন। এবং ১৯৬১ সালে রাশিয়ার পরীক্ষিত একটি বোমার ধ্বংসক্ষমতা ছিল ৫৮ মেগাটন।
রণাঙ্গনে ‘ট্যাকটিক্যাল’ পরমাণু বোমার ব্যবহারে ক্ষয়ক্ষতি হয় ‘সীমিত’। অন্যদিকে, সর্ববিনাশী পরমাণু যুদ্ধ (তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে) জয়ের লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে স্ট্র্যাটেজিক ওয়ারহেড। যেগুলি চোখের পলকে একটি ছোট দেশের সমান ভূখণ্ডকে বধ্যভূমিতে রূপ দিতে পারে।
কিন্তু, ‘সীমিত’ সংজ্ঞাটি আপেক্ষিক। যেমন আমেরিকা হিরোশিমায় যে আণবিক বোমা ফেলেছিল তার ধ্বংসক্ষমতা ছিল মাত্র ১৫ কিলোটন। তাতে কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল, একটি শহর কীভাবে প্রেতপুরিতে রূপ নিয়েছিল চোখের পলকে– আজ সেসব কথা কারোরই অজানা নয়।
জাপানের দুই দুটি শহরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর পৃথিবী পার করেছে অনেক বসন্ত। এই সময়ে, আরও সভ্যতা-বিনাশী শক্তি অর্জন করেছে পরমাণু অস্ত্রের প্রযুক্তি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যাকটিক্যাল বোমা নিক্ষেপ করে ইউক্রেনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতে চায় রাশিয়া। ফলে দেশটি আত্মসমর্পন করুক বা আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য হোক– এটাই মস্কোর লক্ষ্য। দেশটিকে সমর্থন দেওয়া পশ্চিমা জোটেও ভাঙ্গন ধরাতে চায়।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক– সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)- এর সামরিক বিশেষজ্ঞ মার্ক ক্যানসিয়ান অবশ্য মনে করেন, রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে এই অস্ত্রের ব্যবহার করবে না রাশিয়া।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, প্রচলিত লড়াইয়ের ময়দানে পরমাণু বোমার ব্যবহার বিপজ্জনক। এভাবে ২০ মাইল এলাকা দখল করতে একাধিক ট্যাকটিক্যাল বোমা ব্যবহার করতে হবে। এই সীমিত অর্জনের জন্য তৈরি হতে পারে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার বিশাল ঝুঁকি। তিনি আরও বলেন, ‘আবার শুধুমাত্র একটি বোমা নিক্ষেপ করাও যথেষ্ট নয়।’
তবে অন্যভাবেও এ অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ আছে। যেমন চাইলে ইউক্রেনের উপকূলীয় অঞ্চলে পানির উপর বা আকাশসীমায় অনেক উঁচুতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে রাশিয়া। এতে ব্যাপক প্রাণহানি যেমন এড়ানো সম্ভব, তেমনি কিয়েভকে কঠিন পরিণতির বার্তা দেওয়া যাবে। বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করে, ইউক্রেনের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম নষ্ট করে দিতেও পারবে।
আবার ইউক্রেনের প্রধান প্রধান সামরিক ঘাঁটি বা নগর কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বিপুল প্রাণহানির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন পুতিন। এর লক্ষ্য হবে ইউক্রেনের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা।
‘ন্যাটো জোটে বিভাজন এবং পুতিন-বিরোধী বৈশ্বিক মনোভাবে চিড় ধরাতে এই কৌশল গ্রহণ করতে পারে ক্রেমলিন’ –ব্যাখ্যা করেন হোয়াইট হাউসের সাবেক পরমাণু নীতি বিশেষজ্ঞ জন উল্ফসথাল। তিনি বলেন, ‘কৌশলটি সফল হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। বরং পুতিনের মরিয়া হয়ে ওঠার উদাহরণ হিসেবে দেখা হতে পারে’।
কী করবে পশ্চিমারা?
ইউক্রেনে ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক বোমা হামলা হলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে– সে দিকটি আজো স্পষ্ট করেনি পশ্চিমারা। পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার বিভিন্ন উপায় বাস্তবায়নও অনেক জটিল।
রুশ পরমাণু হুমকির মুখে নিজেদের দুর্বল হিসেবে জাহির করতে চায় না আমেরিকা ও ন্যাটো। কিন্তু, ন্যাটো সদস্য নয় এমন একটি দেশ–ইউক্রেনের জন্য তারা রাশিয়ার সাথেও এমন সংঘাত চায় না– যা রূপ নিতে পারে বৈশ্বিক পরমাণু যুদ্ধে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারপরও রাশিয়ার পরমাণু হামলার পর পশ্চিমাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া কোনো উপায় নেই, নাহলে তাদের দুর্বল দেখাবে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত আমেরিকার একার না হয়ে–সামষ্টিকভাবে ন্যাটো জোটকে নিতে হবে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ ক্রোনিগ বলেন, রাশিয়াকে মোকাবিলার জন্যই ১০০টির বেশি ট্যাকটিক্যাল পরমাণু অস্ত্র ন্যাটো সদস্য দেশে মোতায়েন রেখেছে আমেরিকা। ন্যাটো সিদ্ধান্ত নিলে এগুলি দিয়েই পাল্টা জবাব দেওয়া হতে পারে।
তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে দৃঢ়তার পরিচয় দেবে ন্যাটো। আর একইসাথে যেকোনো অবিবেচক সিদ্ধান্তের পরিণতি সম্পর্কে মস্কোকে কঠোর বার্তা দেবে।
‘অবশ্য এর ফলে পাল্টা পরমাণু অস্ত্রের আঘাত হানতে পারে রাশিয়া, ফলে আরও শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার আর পাল্টা-ব্যবহার শুরু হয়ে যেতে পারে। এতে চরম মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে’ – যোগ করেন তিনি।
আবার ন্যাটো পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নাও নিতে পারে। এতে জোটটিকে দুর্বল করার লক্ষ্য হাসিল হবে পুতিনের।
হিম যুগে পৃথিবী
পরমাণু হামলায় বিগড়ে যাবে পৃথিবীর আবহাওয়াও। পরমাণু হামলার পর কমবে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কারণ এত ধোঁয়া নির্গত হয় যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সাদা মেঘের আস্তরণ তৈরি হবে। ১০ শতাংশ জায়গায় সূর্যের আলোর দেখা মিলবে না।
দুনিয়ার সমস্ত পরমাণু বোমার ব্যবহার হলে ১৫০ মিলিয়ন টন ধোঁয়া স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে জমে যাবে। ওজোন স্তরের থাকে উপরে এটি। অনেক জায়গায় বৃষ্টিও আর হবে না। পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত কমে যাবে ৪৫ শতাংশ। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা হবে -৭ থেকে -৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮ হাজার বছর আগে হিম যুগে ফিরে যাবে পৃথিবী। তখন গড় তাপমাত্রা ছিল -৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ দুনিয়ার তাপমাত্রা ১৮ হাজার বছর পিছনে চলে যাবে।
১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় পরমাণু হামলায় ১.৪০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। নাগাসিকায় বোমার তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছিল ৬.৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। ৭৪ হাজার লোক মারা গিয়েছিলেন। হামলার সময় ওই এলাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাত্র ১০ সেকেন্ডে পরমাণু বোমা ধ্বংসলীলা চালায়। বোমা পড়ার কয়েক বছর পরও সেখানে মানুষ ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
এসডব্লিউ/এসএস/০৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ