বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর কোনোটিই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, মানবাধিকার ও জনস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে ভালো করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক র্যাঙ্কিং ডিজিটাল রাইটসের (আরডিআর) সূচকে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত মে মাসে আরডিআর ‘দ্য ২০২২ বিগ টেক স্কোরকার্ড’ নামের সূচকটি প্রকাশ করে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিনটি বিষয়ের আলোকে ১৪টি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিকে মূল্যায়ন করেছে আরডিআর। বিষয় তিনটি হলো পরিচালনপ্রক্রিয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা।
আরডিআর বলছে, এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর কোনোটি ষষ্ঠবারের মতো কৃতকার্য হওয়ার নম্বর (পাসিং গ্রেড) অর্জন করতে পারেনি। তবে কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটু ভালো অবস্থানে আছে টুইটার।
সূচকে ৫৬ শতাংশ স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থানে আছে টুইটার। এরপর আছে ইয়াহু ৫৪, মাইক্রোসফট ৫০, গুগল ৪৭, মেটা ৪৬, অ্যাপল ৪৪, কাকাও ৪৪, ইয়ানডেক্স ৩৫, বাইদু ২৮, ভিকে ২৮, আলিবাবা ২৬, স্যামসাং ২৬, অ্যামাজন ২৫ ও টেনসেন্ট ২৫ শতাংশ।
সূচকে পরিচালনপ্রক্রিয়ার দিক থেকে শীর্ষে মেটা। তারপর মাইক্রোসফট, ইয়াহু, গুগল ও টুইটার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দিক থেকে শীর্ষে টুইটার। তারপর গুগল, মাইক্রোসফট, কাকাও ও মেটা। গোপনীয়তা রক্ষায় শীর্ষে ইয়াহু। তারপর অ্যাপল, টুইটার, মাইক্রোসফট, গুগল ও মেটা।
চিন্তানপ্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার স্বাধীন ও অলাভজনক গবেষণা প্রোগ্রাম আরডিআর। তারা ইন্টারনেটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে কাজ করে। এবার তারা ষষ্ঠবারের মতো সূচক প্রকাশ করল।
আরডিআর বলছে, বিগ টেক স্কোরকার্ডে প্রতিটি কোম্পানি সন্তোষজনক স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানিগুলো কীভাবে মানবাধিকারের চর্চা করে, অনলাইন বিষয়বস্তু পরিমিত করে, যাচাই-বাছাই করে, অ্যালগরিদম পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে, মানুষের ব্যক্তিগত উপাত্ত ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আরডিআর বলছে, বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন, ইউক্রেনে রুশ হামলার মধ্যেও বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যথারীতি ব্যবসা করে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রকৃত মানবাধিকার, নজরদারিভিত্তিক বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করছে। কোম্পানিগুলোকে মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা পূরণে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রসমর্থিত প্রচারণা, ঘৃণ্য বক্তব্য ও সহিংসতার জন্য উসকানিমূলক বার্তা প্রচারের জন্য মেটাকে সমালোচিত হতে হয়েছে। মেটা পরিষেবা প্রয়োগের শর্তাবলি, ব্যবহারকারীকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপননীতি, অ্যালগরিদমের পদ্ধতি, শূন্য রেটিং প্রোগ্রামসহ মানবাধিকার প্রভাব মূল্যায়নের প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
মেটা পরিচালনপ্রক্রিয়ায় ৬৫, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৩৬ ও গোপনীয়তায় ৪৬ শতাংশ স্কোর করেছে। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ, তারা প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিজস্ব নীতি মেনে চলে না।
আরডিআর বলেছে, মেটাকে গত এক বছর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। মূল কোম্পানি ফেসবুক থেকে মেটা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী গুরুত্বপূর্ণ নথি ফাঁস করেছেন। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রসমর্থিত প্রচারণা, ঘৃণ্য বক্তব্য ও সহিংসতার জন্য উসকানিমূলক বার্তা প্রচারের জন্য মেটাকে সমালোচিত হতে হয়েছে। মেটা পরিষেবা প্রয়োগের শর্তাবলি, ব্যবহারকারীকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপননীতি, অ্যালগরিদমের পদ্ধতি, শূন্য রেটিং প্রোগ্রামসহ মানবাধিকার প্রভাব মূল্যায়নের প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা শুধু ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের স্বচ্ছতার প্রতিবেদন করে। মেটা কীভাবে ব্যবহারকারীর উপাত্ত ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না।
ব্যবহারকারীর উপাত্ত কেনা, শেয়ারিং চুক্তি ও তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অন্যান্য চুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর উপাত্ত তারা কীভাবে অর্জন করে, তা প্রক্রিয়া করে বর্ণনা করতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়েছে। কিছু দেশে মেটা মানবাধিকার ও গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছে।
মেটার ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন দেশের সরকারের সেন্সরশিপের চাহিদার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও স্বচ্ছ হতে হবে। ব্যবহারকারীর উপাত্ত ব্যবহারেও স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
ফেসবুকের মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপও ভারতে ভুয়া খবর ছড়ানোর অন্যতম বড় বাহন। আর বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ট্রলিং, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং নারীদের ওপর আক্রমণের কারণে ভারতে টুইটারের ব্যবহারও উল্লেখ করার মতো। গুগলের মালিকানাধীন ইউটিউবেও অসংখ্য ভুয়া খবর ও বিতর্কিত আধেয় প্রচার করা হলেও বিষয়টি সেভাবে সবার দৃষ্টি কাড়ে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বলিউডের অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর তার সমর্থকেরা ইউটিউবে একটি লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) করেন। সেখানে তারা দাবি করেন, সুশান্ত সিংয়ের হত্যার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। ভিডিওটি প্রায় ১২ ঘণ্টা ইউটিউবে ছিল। যদিও পরে পুলিশ জানায়, বলিউড অভিনেতা সুশান্ত আত্মহত্যাই করেছিলেন।
অনলাইন বিশ্বে কেনাকাটা থেকে শুরু করে যে কোনো সেবা গ্রহণে ব্যক্তিগত নানা তথ্য দিতে হয় গ্রাহকদের। এসব তথ্যের নিরাপত্তা ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কারণে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হলে আর্থিকসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন গ্রাহক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তেই আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে থাকতে একরকম বাধ্য হচ্ছি। ফলে দেখা যাচ্ছে, আপনি গুগলে কোনো খাবার হোটেল কিংবা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য সার্চ করেছেন। এরপর ফেসবুক ঢোকার পরেই দেখলেন, ফেসবুক ওই সংশ্নিষ্ট পণ্যের বিজ্ঞাপন আপনার ওয়ালে প্রদর্শন করতে শুরু করেছে!
বিষয়টি কতটা ভয়ংকর দেখেন, চান বা না চান; গুগলে আপনি কী করেছেন তা জেনে নিচ্ছে ফেসবুক! ব্যবসা নিয়ে গুগল ফেসবুকের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আপনাকে দিয়ে ব্যবসার অর্থ ভাগাভাগিতে কতটা উদার তারা! এভাবেই অনলাইনে প্রতিনিয়ত আমাদের সকল গোপনীয়তা সকল ডাটা শেয়ার হচ্ছে। কে কখন কীভাবে আমার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করছে তার হদিসও হয়ত আমরা জানি না। এরই প্রেক্ষাপটে কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ভালোভাবে নিরাপদে রাখা যায়, তা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৩
আপনার মতামত জানানঃ