এক সামাজিক জরিপের ফল থেকে জানা গেছে, পথশিশুদের ৯৮.৫ শতাংশই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তারা প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাই নিচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সেমিনারে জরিপের এ ফলাফল তুলে ধরা হয়।
‘পথশিশুদের বঞ্চনা ও অধিকার’ বিষয়ক এই সেমিনারের আয়োজক ছিল যৌথভাবে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, লিডো ও যুক্তরাজ্যের কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন এবং কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩১ শতাংশ) শিশু একা থাকে, ১২ শতাংশ রাস্তায় থাকে অন্যদের সঙ্গে। ১১ শতাংশ শিশুরা অনাথ। ৩৫ শতাংশ জানে যে, তাদের মা অথবা বাবা মারা গেছে। প্রায় অর্ধেক (৪৪ শতাংশ) শিশু রাতে বস্তিতে ঘুমায়। অন্যরা টার্মিনালে, রেল স্টেশন, লঞ্চ ঘাট, যানবাহনে, পার্কে এবং রাস্তার পাশে ফুটপাতে ঘুমায়। বেশিরভাগ পথশিশু পেটের তাগিদে গড়ে ১০ ঘণ্টা কাজ করে। ৩৫ শতাংশ ভিক্ষা করে। ৪২ শতাংশ রাস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করে।
ফলাফলে বলা হয়, ঢাকা ও বরিশালের পথশিশুদের জন্য সহিংসতা ও নির্যাতন সাধারণ ঘটনা। তিন-চতুর্থাংশেরও অধিক (৭৯ শতাংশ) শিশু জীবনের কোনো এক পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে মানসিক (৭৬ শতাংশ), শারীরিক (৬২ শতাংশ) এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫ শতাংশ। ৬০ শতাংশ গত তিনমাসে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ৩৫ শতাংশ কাশি, ২৬ শতাংশ সর্দি, ২৫ শতাংশ মাথাব্যাথা এবং ২২ শতাংশ পেটের ব্যথায় আক্রান্ত হয়েছে। ৮৫ শতাংশ শিশু স্থানীয় ওষুধের দোকান বা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। ৬২ শতাংশ পথশিশু গণশৌচাগার ব্যবহার করে, ৭ শতাংশ অন্যান্য জায়গার শৌচাগারে প্রবেশ করতে পারে। বাকিরা ড্রেন বা খোলা জায়গা ব্যবহার করে।
জরিপে আরও উঠে আসে, ২০২০ এর প্রাথমিক লকডাউনে ৭২ শতাংশ পথশিশু খাদ্যাভাবে ভোগে। ৬৫ শতাংশ কাজ হারিয়েছিল। ৫৩ শতাংশ পথশিশু থাকার জায়গা হারায়।
সরকার শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার কর্মীসহ নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকার পরও শিশুদের সার্বিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি।
বাংলাদেশে পথশিশুদের সংখ্যা কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ পথশিশু রয়েছে; যার প্রায় অর্ধেকেরই বাস ঢাকায়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়ে শিশুরা। ১৪.৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়; মেয়ে শিশুরা বেড়ে ওঠে পতিতা হিসেবে।
অধিকারকর্মীরা বলেন, শিশুদের পথে থাকতে হয় কেন? শিশুরা কী পথে জন্মায়? পথে কোনো শিশু জন্মানোর কারণেই সে পথশিশু হয় না। জন্মের সময় প্রতিটি শিশুই তার নাগরিক অধিকার নিয়ে জন্মায়। আমাদের সমাজই পথশিশুদের পথশিশু হিসেবে তৈরি করে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এসব সনদ ও আইনে। কিন্তু পথশিশুরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত।
তারা বলেন, সরকার শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার কর্মীসহ নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকার পরও শিশুদের সার্বিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি।
পথশিশু একটি জাতীয় সমস্যা, জাতীয় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। পথশিশুদের জন্য প্রয়োজন একটি পরিকল্পিত নীতিমালা ও প্রকল্প এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন। তখনই আশা করতে পারি, একটা নির্দিষ্ট সময় পর পথশিশু নামক কোনো টার্ম বাংলাদেশে থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৮
আপনার মতামত জানানঃ