স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে ৯৬ বছর বয়সে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান ঘটেছে সম্প্রতি। ৭০ বছর ধরে তিনি যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন। রাজা ষষ্ঠ জর্জের মেয়ে হিসেবে ১৯৫৩ সালে সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়া এলিজাবেথের রাজত্বই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দীর্ঘতম।
১৯৫৩ সালের ২ জুন ২৬ বছর বয়সে রানি হিসেবে অভিষেক হয় দ্বিতীয় এলিজাবেথের। তিনি এমন সময় রানি হন যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হবার পালা শুরু হয়েছে। ১৫৭৮ সালে রানি প্রথম এলিজাবেথের সময় থেকে ইংল্যান্ডের আজকের ব্রিটেনের বাইরে সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুরুতে শুধু আমেরিকা মহাদেশে হলেও পরে তা বিস্তার লাভ করে এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে। এক পর্যায়ে বিশ্বের প্রায় এক পঞ্চমাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে– যে কারণে বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ শুধু ব্রিটেনের রানিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আরো ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান – যে দেশগুলোর সবই একসময় ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। কিন্তু নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজত্বকালের বাস্তবতা হয়তো হবে অন্য রকম।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু দেশটিতে রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিতর্ককে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছ্র, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল, একজন কট্টর রিপাবলিকান হলেও, টিভিতে প্রয়াত রানির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার চোখে জল আসে। তবে টার্নবুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার ওপর গণভোট হয়তো শিগগিরই হবে না – কিন্তু একদিন এটা হতেই হবে, এটা অবধারিত।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ বলেছেন, এখন রানির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়, কিন্তু কোন এক সময় এ গণভোট হবে।
অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্র করা হবে কিনা- এ প্রশ্নে এর আগে ১৯৯৯ সালে একটি গণভোট হয়েছিল। কিন্তু তাতে বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ানই রানিকে রাষ্ট্রপ্রধান রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন একটা গুরুতর পার্থক্য ঘটে গেছে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথই ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাথে রাজতন্ত্রের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় যোগসূত্র। অনেকে বলেছেন, রানি ছিলেন তাদের পরিবারের সদস্যের মত।
সেই রানিই এখন প্রয়াত । রাজা তৃতীয় চার্লসের জন্য অনেক অস্ট্রেলিয়ানেরই শুভেচ্ছার অভাব নেই, কিন্তু তাদের সেন্টিমেন্ট ঠিক একই রকম নয়, বলছেন বিবিসির সংবাদদাতা শায়মা খলিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়া্নরা রানিকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি তাদের স্বাধীন জাতীয় চেতনাও খুব জোরালো। টার্নবুল বলছেন, রানিকে আমরা ভালোবাসি কিন্তু আমরা একটা স্বাধীন দেশ এবং আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান আমাদেরই একজনের হওয়া উচিত।
এমনকি খোদ ব্রিটেনেও এমন লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে – যারা রাজতন্ত্রের বিলোপ চান, যুক্তরাজ্যকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চান।
পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ – যারা একসময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অংশ ছিল – তাদের জনগণের একটা ক্রমবর্ধমান অংশের মধ্যেই কাজ করছে এমন ভাবনা। এসব দেশের অনেক লোকই ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে আর তাদের রাষ্ট্রের শীর্ষে দেখতে চাইছে না।
মাত্র কিছুকাল আগেই বারবাডোজ ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তারা রানি এলিজাবেথকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়াও বহুকাল ধরেই প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছেন ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত আরো কিছু দেশের অনেকে।
বারবাডোজ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার পর সংবাদমাধ্যমে বিশ্লেষকরা বলেছেন এটা এক ডমিনো এফেক্ট সৃষ্টি করতে পারে – অর্থাৎ অল্প কিছুকালের মধ্যেই হয়তো আরো অনেক দেশই ব্রিটেনের রাজাকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে।
এমনকি খোদ ব্রিটেনেও এমন লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে – যারা রাজতন্ত্রের বিলোপ চান, যুক্তরাজ্যকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক দেশই ঔপনিবেশিক শাসন ও রাজতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন নির্বাচিত ব্যক্তিকে গ্রহণ করে। উপমহাদেশে ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হলেও প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় ১৯৫০ সালে, পাকিস্তান হয় ১৯৫৬ সালে।
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ১৯৭০-এর দশকে গায়ানা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো এবং ডমিনিকা তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে ব্রিটেনের রানিকে সরিয়ে দেয়। এছাড়া ফিজি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় ১৯৮৭ সালে, আর মরিশাস ১৯৯২ সালে।
তবে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল এমন অনেক দেশই প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার পরও কমনওয়েলথ জোট গঠনের মাধ্যমে ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক রেখেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামন্ততন্ত্রকে হটিয়ে পুঁজিবাদী শ্রেণি ক্ষমতাসীন হলেও তারা সামন্ততান্ত্রিক রীতি, নীতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ব্যাপক সমঝোতা করে বা শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশ পরিচালনা করে আসছে। ফলে ব্রিটিশ জনগণ আজও নাগরিক না হয়ে প্রজা। তেমনি উপনিবেশের যে বিস্তার পুঁজিবাদী শ্রেণির হাত ধরে ঘটেছে, ওই বিস্তারে প্রতীকী অর্থে তাদের নেতৃত্বে থেকেছেন সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ রাজা বা রানি।
সামন্ততান্ত্রিক ব্রিটেনের উত্তরাধিকার রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ছিলেন পুঁজিবাদী ব্রিটেনের প্রতীকী নেতা। তার সময়কালেই প্রায় সমস্ত উপনিবেশ হারিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আগামী দিনগুলিতে খোদ ব্রিটেন নিজেই টিকে থাকবে কিনা এ প্রশ্ন উঠেছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন বা রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত যাই হোক না কেন, ইতিহাসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আসন থেকে যাবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ শাসক হিসেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ