সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন ছিল কৃষিপ্রধান স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ফলে আমদানিতে তাদের ছিল প্রবল অনাগ্রহ। তারা শুধু রুপা আর আফিম আমদানি করত। চীনের রূপার চাহিদা তখন তুঙ্গে। এছাড়া সে সময় আফিম যে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা জানত না চীনারা। তারা আফিম ব্যবহার করত ছোটখাটো রোগের চিকিৎসার ওষুধ হিসেব। এই আফিম আসত মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।
এই আফিমকে কেন্দ্র করেই আফিম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল চীন ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে। ১৮৩৯ থেকে ১৮৬০ এর মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হলেও বাস্তবে এটা দুটি ভিন্ন যুদ্ধ ছিল। যার প্রথমটি ১৮৩৯ সালে শুরু হয়েছিল এবং ১৮৪২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং দ্বিতীয়টি ১৮৫৬ সালে শুরু হয়ে ১৮৬০ সালে শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধে ফ্রান্স ব্রিটিশদের সমর্থনে অংশ নিয়েছিল।
এদিকে ব্রিটিশ বণিকদের কাছে চীনের চা, সিল্ক এবং চিনামাটির বাসন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল। কিন্তু চীনারা কেবল রৌপ্যের বিনিময়ে তাদের পণ্য বিক্রি করত। এই বাণিজ্য চীনাদের অনুকূলে ছিল পুরোপুরিভাবে। এর ফলে ব্রিটেনের প্রচুর রুপা চীনের কাছে চলে যায়। আজকে যে চা আমরা পান করি তা শিখিয়েছিল প্রথমে চীনারা। তো ব্রিটিশরা তখন সবেমাত্র চা খাওয়া শিখেছে। চা ব্রিটেনে তখন খুব জনপ্রিয়। কিন্তু সে চা কিনতে ব্রিটিশদের গুনতে হতো চড়া মূল্য। তখন বিনিময় প্রথা চালু ছিলো। চীনের থেকে স্বভাবতই চা কিনতে হতো রূপার বদলে। তো ব্রিটেনের আরেক সমস্যা ছিল, তাদের রূপা আনতে হতো মেক্সিকো থেকে। মেক্সিকোতে চাহিদা ছিল সোনার। তো সোনার বিনিময়ে রূপা এনে সেই রূপার বিনিময়ে কিনতে হতো চা। এভাবে চা কিনে আনায় দুর্বল হয়ে পড়ছিল ব্রিটিশ অর্থনীতি।
তখন তৎকালীন ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অন্তর্ভুক্ত একটি পরাধীন ভূখণ্ড। এখানে উৎপাদিত আফিম ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহযােগিতায় চোরাচালানের মাধ্যমে চীনে প্রেরণ করা শুরু করে। একসময় চীনের জনগণ ব্রিটিশদের কাছ থেকেই আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা শেখে। ফলে আফিমের চাহিদা আরও বেড়ে যায় চীনে। চীনের জনগণ আফিমের নেশায় ব্যাপকভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। আফিমের কল্যানে দ্বিগুণ রপ্তানি হতে থাকে চা। অর্থাৎ ১ কেজি আফিমের বদলে মিলতো ২ কেজি চা। এক হিসাব মতে দেখা যায় যে, যেখানে ১৮০০ সালে চীনের মোট আমদানীকৃত আফিমের পরিমাণ ছিল ২ হাজার পেটি, সেটি ধারাবাহিকভাবে ১৮২০ সালে ১০ হাজার পেটি এবং ১৮৩৮ সালে ৪০ হাজার পেটিতে পৌঁছায়। এভাবেই আফিম রপ্তানি এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা চীনাদের সামজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দেয়।
কয়কটি প্রদেশের প্রায় নব্বই শতাংশ লোক মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে চীনারা আফিমের বিনিময় মুল্য পরিশোধ করতো তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী দিয়ে চিনামাটির বাসন, রেশম এবং চা ইত্যাদি। কিন্তু ক্রমেই চাহিদা বাড়ায় আফিমের মূল্য বেড়ে যায় এবং সাধারণ পণ্য দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এর ফলে তারা রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে আফিম ক্রয় করতে থাকে এবং চীনের রৌপ্যের ভাণ্ডার অল্প কিছু দিনের মধ্যে শেষ হওয়া শুরু করে। এতে করে সারা রাজ্যে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা শুরু হয়; টনক নড়ে সম্রাটের। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এর জন্য চীনা সরকার বিজ্ঞপ্তি বা হুকুম জারি করলেন, দেশে কোনাে অবস্থাতেই আফিম আমদানি করা চলবেনা।
এদিকে এই আফিমের ব্যবসা ব্রিটিশদের কাছে ছিল অসম্ভব লাভজনক। আফিম ব্যবসার টাকা তখন চা এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই তারা এই ব্যবসা গুটাতে কিছুতেই আগ্রহী ছিল না। তারা গােপনে গােপনে আফিমের বিক্রি চালিয়ে যেতে লাগলাে। সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তারা মােটা অংকের টাকা উৎকোচ দিত। ধীরে ধীরে চীনা সরকার একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে ব্রিটিশ বণিকদের এই অবৈধ ব্যবসার প্রসারে। শেষ পর্যন্ত চীন সরকার ঠিক করলেন এই মাদক ব্যবসা বন্ধ করার জন্য বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তা নিয়ােগ দেবেন। বিশেষ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হলেন লিন নামের এক চৌকশ কর্মকর্তা।
যেহেতু দক্ষিণ চীন ছিল এই অবৈধ ব্যবসার সবচেয়ে বড় আখড়া, তাই লিন সেখানে গিয়ে আদেশ জারি করলেন সমস্ত ইংরেজ বণিকদের কাছে যত আফিম আছে সব সরকারের কাছে জমা দিতে। ১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ লিন ক্যান্টন শহরের যে অঞ্চলে বিদেশি বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে উঠেছিল, সেই অঞ্চল অবরােধ করেন। তিনি ব্রিটিশ সুপারেন্টেন্ড ক্যাপ্টেন চার্লস এলিয়ট সহ ৩৫০ জন ব্রিটিশ বণিকদের অবরুদ্ধ করেন এবং তাদের ২০ হাজার আফিমের বাক্স বিনষ্ট করে দেন। চীনের ই পদক্ষেপ সহ্য করতে না পেরে এলিয়ট লন্ডনে সৈন্য পাঠানাের অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন। এভাবে পরিস্থিতি যখন ক্রমশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তখন এক ইংরেজ নাবিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে, যাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয় প্রথম আফিম যুদ্ধ; যা ইঙ্গ চীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত।
লন্ডন হতে সৈন্য আসার আগপর্যন্ত বেশ কয়েকটি সংঘাতের পরে ১৮৩৯ সালের নভেম্বরে মূল লড়াই শুরু হয়। ক্যান্টন থেকে ব্রিটিশ শরণার্থীদের সরিয়ে নেওয়ার সময় এইচএমএস “ভােলাজ” এবং এইচএমএস ‘হায়াসিন্থ’ ২৯ টি চীনা জাহাজকে পরাজিত করে। পরের বছর ২১ শে জুন, কমােডাের স্যার গর্ডন ব্রেমার দ্বারা পরিচালিত একটি নৌ বাহিনী মাকাও থেকে এসে উত্তরের দিকে চুশানে চলে যায় এবং ৫ জুলাই টিং-হাই বন্দরে বােমা ফেলে, যা পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল জর্জ বুরেলের সেনাবাহিনী দ্বারা দখল করা হয়েছিল। প্রায় দুই বছরের মতাে সর্ব শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করার পর ভাগ্যের নির্মম পরিনতি হিসেবে চীনা শক্তি পরাজিত হয়।
এ যুদ্ধে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি চীনা সৈন্য মারা যায় অপরদিকে মাত্র ৩৫০ জনের কাছাকাছি ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধের পর ইংরেজ ও চীনদের মাঝে ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্ট ঐতিহাসিক নানকিং চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ব্রিটিশরা এই চুক্তির মাধ্যমে আফিমের বাণিজ্য করার বিশেষ অধিকার লাভ করে এবং হংকং দ্বীপ দখল করে নেয়। প্রায় ২৫০ বছর হংকং দ্বীপ তাদের দখলে থাকে। এছাড়াও চীনের কাছ থেকে ব্রিটেইন ২১ মিলিয়ন রৌপ্যমুদ্রা ক্ষতিপূরণসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ‘সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি’র মর্যাদা আদায় করে নেয়।
বেশ কিছু কারনে এই নানকিং এর সন্ধি সুদূর প্রাচ্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথমত, এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে চীনের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এই দুর্বলতার সুযােগে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ চীনের ওপর একের পর এক অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, চুক্তি অনুযায়ী হংকং বিদেশিদের দখলে যাওয়ার ফলে চীনের আঞ্চলিক অখন্ডতা বিপন্ন হয়। উপরন্তু বিদেশি পণ্যের উপর চীন যথেষ্টভাবে শুল্ক আরােপের অধিকার হারায়, যা ছিল চীনের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিপন্থী। এক কথায় এই সন্ধির ফলে চীনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। চীনারা বিদেশী বণিকদের কাছে তাদের পাঁচটি বন্দর উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয় এবং বিদেশি পণ্যের উপর অত্যন্ত অল্প পরিমাণে বাণিজ্য শুল্ক ধার্য করে। যার ফলশ্রুতিতে বিদেশি পণ্য চীনের বাজারে স্রোতের মতাে ঢুকতে থাকে। তখন পর্যন্ত চীনের অর্থনীতি গ্রামীণ এবং সম্পূর্ণ আত্ননির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এই নির্ভরশীলতা বিনষ্ট হয় বিদেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশের ফলে। চীনের অর্থনীতি ক্রমশ উপনিবেশ-অর্থনীতি তে রূপান্তরিত হয়। দেশীয় শিল্প বিনষ্ট হওয়ায় অসংখ্য মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে।
চীনে পাশ্চাত্যশক্তিবর্গের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এরপর ১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝি ইউরোপীয় শক্তি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক চুক্তির পুনঃনিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। এই প্রচেষ্টায় নেতৃত্বে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। তবে পশ্চিমে আরও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে অবিলম্বে সম্রাট জিয়ানফংয়ের কিং সরকার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। ইতিমধ্যে অ্যারো জাহাজের ঘটনা উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। জাহাজটি চিনা মালিকানাধীন হলেও হংকংয়ের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে এর রেজিস্ট্রশন ছিল। তাই ওই জাহাজে ব্রিটিশ পতাকা তোলা ছিল। চিনা অফিসার ও সৈন্যরা জলদস্যু পাকড়াও করতে গিয়ে ওই ব্রিটিশ পতাকার ক্ষতি করে ফেলে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ক্যান্টন কর্তৃপক্ষের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করে। যা ক্যান্টন কর্তৃপক্ষ অগ্রাহ্য করে। ব্রিটেন তখন জাতি অবমাননার অভিযোগে চীনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বিরাট ব্রিটিশ বাহিনী প্রেরণ করে। এদিকে কোয়াংসি প্রদেশে এক ফরাসি ধর্মপ্রচারককে নামমাত্র বিচারে চীনা কর্তৃপক্ষ মৃত্যুদন্ড দেয়। যদিও সেখানে ফরাসিদের অনুপ্রবেশের কোনো অধিকার ছিল না। ফরাসিরা ব্রিটিশদের সাথে যুক্ত হয়। ফলে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের সূচনা হয়। আমেরিকা ও রাশিয়া যুদ্ধে যোগদান না করলেও বৃটেনের পক্ষেই তাদের মত ছিল।
১৮৫৬ সালে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শুরু হয় এবং এতে চীনের রাজধানী পিকিং পর্যন্ত দখল করে চীন-সাম্রাজ্যের গর্ব হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত গ্রীষ্ম-প্রাসাদ লুট করে তা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এমনকি ক্যাণ্টনের ভাইসরয় ইয়ি মিংচেনকে অপমানজনকভাবে বন্দি করে কোলকাতায় নির্বাসিত করা হলে সেখানে তার অনাহারে মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের শেষে চীনকে অপমানজনক ‘তিয়ানজিন চুক্তি’ করতে হয় যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-ফরাসী ও তাদের সহযোগী রুশ-মার্কিন শক্তির সাথে। এই চুক্তি ছাড়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বেইজিংয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছিল এমন এক শহরে, যেখানে বিদেশীদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, নতুন বন্দর বাণিজ্যের জন্য সক্ষম করা হয়েছিল এবং পশ্চিমা দেশগুলিকে ইয়াংটি নদী এবং অভ্যন্তরীণ চিনের কিছু অংশ দিয়ে যাতায়াত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। রাশিয়াও একটি স্বতন্ত্র চুক্তির মাধ্যমে চীনের কাছ থেকে আমুর নদীর বাম তীর হস্তগত করে নেয়, যেখানে তারা ভ্লাদিভস্তক বন্দর প্রতিষ্ঠা করে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ