ফেসবুক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী মাসে তাদের দুইশ সত্তর কোটি নিয়মিত ব্যবহারকারী রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রামের মতো পণ্যও ব্যবহার করে।
কিন্তু ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে।
চার বছরের পুরোনো ‘ক্লাস অ্যাকশন’ মামলাটি করেছিলেন একদল ফেসবুক ব্যবহারকারী। তাদের অভিযোগ ছিল, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো অন্যান্য সংস্থাকে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করে ফেসবুক সেবাগ্রহীতাদের গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘন করেছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার জন্য ফেসবুকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের এ মামলা হয়।
কেলেঙ্কারির ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার দুই মাস পরে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আদালতে জমা দেওয়া এক নথিতে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলাটি সমঝোতা করতে তারা সম্মত হয়েছে। তবে কী পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মামলায় সমঝোতা হচ্ছে, তা প্রকাশ করা হয়নি।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনাটি সামনে নিয়ে আসেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক কর্মী ক্রিস্টোফার উইলি।
তিনিই প্রথম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ) প্রশ্নে গণভোটে ভূমিকা ছিল তার সাবেক কর্মস্থলের। এ ব্যাপারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে সহযোগিতা করেছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আলেকসান্দ্র কোগান। তিনি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করে ফেসবুকের প্ল্যাটফর্মে ছেড়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে।
ক্রিস্টোফার উইলির ভাষ্যমতে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ওই সব তথ্য ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারশিবিরকে সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ওই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রিপাবলিকান ভোটারও চিহ্নিত করা হয়।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সম্ভবত পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তবে পরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে, ৮ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্য বেহাত হয়েছে।
তথ্য চুরির কেলেঙ্কারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিনির্ধারকদের তোপের মুখে পড়েন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। পরে বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে হাজির হতে হয় ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে। ওই শুনানিতে কয়েকবার মাফ চাওয়ার পাশাপাশি গোপনীয়তা নীতিমালা নতুন করে করার প্রতিশ্রুতিও দেন জাকারবার্গ।
এদিকে ফেসবুক নিয়ে এই মামলার ক্ষেত্রে দফায় দফায় জাকারবার্গকে রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর আগে গত বছর কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি ঘিরে পৃথক আরেকটি মামলায় জাকারবার্গকে রক্ষার চেষ্টা করে মেটা। ওই মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) ৪৯০ কোটি মার্কিন ডলার দাবি করে। এই কেলেঙ্কারি প্রকাশের পরপর ফেসবুকের শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়।
দ্য অবজারভারের সাংবাদিক ক্যারল ক্যাডওয়ালাডার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, জাকারবার্গকে কেলেঙ্কারিসংক্রান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া থেকে সরিয়ে রাখতে ফেসবুক যেকোনো পরিমাণ অর্থ দিতে প্রস্তুত, তা প্রমাণিত হয়েছে।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্য কেলেঙ্কারি ঢাকা দেওয়ার বিষয়সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াতে জাকারবার্গ কতটা মরিয়া, তার প্রমাণ এটা।
ক্যারল ক্যাডওয়ালাডার আরও বলেন, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্য কেলেঙ্কারি ঢাকা দেওয়ার বিষয়সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াতে জাকারবার্গ কতটা মরিয়া, তার প্রমাণ এটা।
কিছুদিন পরেই আইনজীবীদের ছয় ঘণ্টার জন্য জেরার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল তার।
তবে সম্প্রতি আদালতে জমা দেওয়া নথিতে আর্থিক শর্তাবলি বা প্রাথমিক নিষ্পত্তির বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়নি। তাতে সান ফ্রান্সিসকো ফেডারেল আদালতের বিচারককে এই ক্লাস অ্যাকশন মামলাটি লিখিত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ৬০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষমাণ রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে।
২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ফেসবুক ও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ঘিরে তদন্তের দাবি ওঠে। ফেসবুকের এই কেলেঙ্কারিতে সরব হন সরকার ও রাজনীতির বাঘা বাঘা ব্যক্তি। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরপরই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের নির্বাহী আলেকজান্ডার নিক্সকে বরখাস্ত করে। রাজনীতিবিদদের ফাঁসাতে ঘুষ দেওয়া, যৌনকর্মী ব্যবহারসহ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার গোপন কৌশল ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন তিনি। পরে সে তথ্য জনসমক্ষে চলে আসে।
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে বন্ধ হয়ে যায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। বিশ্বজুড়ে কঠোর সমালোচনা ছাড়াও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে কয়েকটি দেশ। কিন্তু বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন জাকারবার্গ।
বিশ্বে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব। যুগের চাহিদায় দিন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। ফেসবুক ছাড়া এখন ভাবাই অসম্ভব। কী নেই এখানে? চাইলেই সবকিছু মেলে নেট দুনিয়ায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ভুয়া তথ্য প্রচার, অশালীন মন্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। এ ছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদে সমর্থন ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। মানুষকে বিপথগামী করতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
ফেসবুককে গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে অভিযোগ করেছেন সদ্য নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা। এছাড়া ফেসবুকের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ও গুজবকে প্রাধান্য দেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
রেসা বলেন, ফেসবুক গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যটি ঘৃণা, ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানো রুখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফেসবুক তথ্য নিয়ে একেবারেই নিরপেক্ষ নয় বলে অনেকবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিরপেক্ষতার চেয়ে ঘৃণা, ক্ষোভ এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর উপরই বেশি গুরুত্ব দেয় জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৮
আপনার মতামত জানানঃ