অত্যন্ত নিরীহ একটি প্রাণী খরগোশ। অথচ একেই কিনা সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক জৈবিক আক্রমণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে পৌনে দুইশত বছর ধরে। ১৮৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে এমন অভিযোগের সূত্রপাত ঘটে অস্ট্রেলিয়ায়। সম্প্রতি দাবিটিকে আরো জোরালো করেছে ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএনএএস)’-এর একটি গবেষণায়।
মূলত বুনো খরগোশ কখনোই অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় কোনো প্রাণী ছিল না এবং সেখানে এটিকে ‘অনুপ্রবেশকারী প্রজাতি’ হিসেবেই ধরা হয়। অস্ট্রেলিয়ার কৃষকেরা বলছেন, এই প্রজাতির খরগোশ খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং দলবদ্ধভাবে তাদের ফসলের ও জমির ক্ষতিসাধন করে, যা চলতে থাকলে অত্যাধিক ভূমি ক্ষয় ও অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হবে।
ঐতিহাসিক দলিলপত্র ঘেঁটে গবেষকরা জানতে পেরেছেন, ১৮৫৯ সালে থমাস অস্টিন নামক একজন বসতি স্থাপনকারী তার জন্মভূমি ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশ নিয়ে আসেন।
প্রাথমিকভাবে মেলবোর্নে ২৪টি খরগোশ এনেছিলেন তিনি। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যে প্রাণীগুলোর সংখ্যা কয়েক হাজারে গিয়ে ঠেকে! এরপর দিন দিন এগুলোর প্রজনন শুধু বৃদ্ধিই পেয়েছে।
গবেষকদের ভাষ্যে, “জৈবিক আগ্রাসন পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একটি প্রধান কারণ। আর অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ প্রজাতির খরগোশের বসতি গড়ে ওঠা ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ধ্বংসাত্বক জৈবিক আগ্রাসন।”
পিএনএএস’র গবেষণাটির প্রধান লেখক ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জোয়েল আলভেস আরও যোগ করেন, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়াজুড়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রজাতির প্রাণী এলেও, এই একদল খরগোশের কারণে দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ জৈবিক আগ্রাসন ঘটেছে, যার প্রভাব আজও দৃশ্যমান।
এই একটি প্রাণীর কারণে পুরো অস্ট্রেলিয়ায় বিপর্যয় নেমে এসেছে এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই খরগোশই এখানে সবচেয়ে দ্রুত বংশবিস্তার করেছে।
তবে গবেষণায় অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশ আমদানির আরও পুরনো একটি ইতিহাসও উঠে এসেছে। ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ জাহাজের প্রথম বহরে করে ৫টি খরগোশ সিডনিতে এসে পৌছায় এবং পরবর্তী ৭০ বছরে আরও ৯০টি খরগোশ আমদানি করা হয় এ অঞ্চলে। তবুও অস্টিনের আনা ২৪টি খরগোশকেই কেন এ অঞ্চলে প্রথম খরগোশের বিস্তারের জন্য দায়ী করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একেবারে শুরুতে আসা অস্ট্রেলিয়ান খরগোশের মধ্যে গৃহপালিত ভাব বেশি ছিল এবং এগুলো নরম-ঝোলানো কান ও রঙিন পশমবিশিষ্ট ছিল। কিন্তু থমাস অস্টিনের বুনো খরগোশের উত্তরসূরি খরগোশদের মধ্যে শিকারী আচরণ স্পষ্ট। তাই অস্টিনের খরগোশগুলোকেই এই বিপর্যয়ের মূল হোতা হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে।
নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণার সহ-লেখক বলেন, “এই প্রাণীগুলোকে যদি পোষা প্রাণী হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে কম দেখা যাবে তা হলো শিকার-বিরোধী মনোভাব যা শেখানোর পাশাপাশি বিবর্তিতও হয় প্রাণীর মধ্যে।”
অস্ট্রেলিয়ায় এই মুহূর্তে ২০০ মিলিয়ন খরগোশের বাস। গবেষকরা বলছেন, “অস্ট্রেলিয়ায় পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে এখানে সহজেই জৈবিক আগ্রাসন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ওই একদল বুনো খরগোশের জেনেটিক মেকআপের কারণেই এ অস্ট্রেলিয়ায় সর্বকালের সবচেয়ে ধ্বংসাত্বক জৈবিক আগ্রাসনটি ঘটে গেছে।”
এছাড়াও, অস্ট্রেলিয়ার রুক্ষ আবহাওয়ার মধ্যেও কিভাবে খরগোশগুলো টিকে আছে এবং নির্বিঘ্নে বংশবিস্তার করে যাচ্ছে, তা নিয়েও গবেষণা করেছেন গবেষকরা।
অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তালিকাটা বেশ লম্বা। দশকের পর দশক ধরে দেশটিতে ‘খরগোশ প্লেগ’ ছড়ানোর পেছনে এই প্রাণীটি দায়ী। এখনো অস্ট্রেলিয়া বুনো খরগোশের প্রজনন কমিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে।
গবেষকরা ইতোমধ্যেই অস্ট্রেলিয়ায় কঠোর জৈব-নিরাপত্তা বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
গবেষকরা বলেন, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জৈবিক আগ্রাসন বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় একটি হুমকি। আপনি যদি খরগোশের বিস্তার প্রতিরোধ করতে চান তাহলে আপনাকে আগে বুঝতে হবে কিভাবে এগুলো নির্বিঘ্নে প্রজনন ঘটাতে পারছে। এ ঘটনা আমাদের প্রমাণ করে দিয়েছে যে একজন বা গুটিকয়েক ব্যক্তির ভুল কাজের ফলাফল হিসেবে কিভাবে সার্বিক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে।
এসডব্লিউএসএস১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ