চাকরির নামে অসহায় নারীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে অবৈধকাজ ও নির্যাতন করে আসছিলে ‘মেসার্স কনকর্ড অ্যাপেক্স’ নামে লাইসেন্সধারী এজেন্সি। ভূক্তভোগীরা যাতে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারেন সেজন্য রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি কিংবা অভিযোগ করবো না মর্মে একটি কাগজে সই করিয়ে নিতো প্রতিষ্ঠানটি। এমন দু’জন ভুক্তভোগী নারী গত শনিবার রাতে হযরত শাহজালাল (রহঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। এরাসহ সম্প্রতি কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব পল্টন সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে এজেন্সির মালিক আবুল হোসেন (৫৪) ও তার সহযোগী আলেয়া বেগমকে (৫০) গ্রেপ্তার করে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে জানায় র্যাব।
র্যাব জানায়, প্রতারক ওই এজেন্সি কোনো ঝামেলা হলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে না এমন চুক্তিও করেছিল ভুক্তভোগীদের সঙ্গে। সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হতো।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান কনকর্ড অ্যাপেক্স রিক্রুটিং এজেন্সি। প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র, তালাকপ্রাপ্ত, স্বামীর সংসারে নির্যাতিত নারীদের টার্গেট করে বিদেশে ভালো বেতন ও বিনামূল্যে হজ করার প্রলোভন দেখাতো। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার নারীশ্রমিককে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে তারা। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর প্রতিশ্রুতির কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা হতো না বরং বিভিন্ন অবৈধকাজে বাধ্য করা হতো নারীদের।
সম্প্রতি কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর পল্টনে সিটি হার্ট শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে এজেন্সির মালিক আবুল হোসেন (৫৪) ও তার সহযোগী আলেয়া বেগমকে (৫০) গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রতারক ওই এজেন্সি কোনো ঝামেলা হলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে না এমন চুক্তিও করেছিল ভুক্তভোগীদের সঙ্গে। সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হতো।
র্যাব জানায়, দেশে ফেরত আসা ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজনকে নয় মাস এবং আরেকজনকে ছয় মাস আগে সৌদি আরব পাঠানো হয়। মেসার্স কনকর্ড অ্যাপেক্স এজেন্সির সঙ্গে তাদের চুক্তি ছিল, সৌদি গিয়ে চাকরি পাবেন। কিন্তু সৌদি পৌঁছানোর পর তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। কাজের নামে চালে অমানবিক নির্যাতন।
এই নারীদের একজন মাত্র তিন মাসের বেতন পেয়েছেন। বাকি মাসগুলো তার ওপর নির্যাতন চলে। আর আরেকজন নারী দুই মাসের বেতন পান।
ভুক্তভোগী একজন নারী বলেন, তাকে আটকে রেখে মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছে। পরে একজন বাঙালির সহায়তায় তার স্বামীর কাছে বিষয়টি জানানো হয়।
ওই নারী বলেন, অনেক মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। আপনারা যদি পারেন তাদের সাহায্য করেন।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক আরও বলেন, সৌদি আরবে বিক্রির প্রস্তুতি চলছিল ওই নারীদের। এমন আরও প্রায় ৯০ জন আছেন একই দুরবস্থায়।
আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, এজেন্সির কাগজপত্র সব ঠিক আছে। কিন্তু তারা এই ধরনের অনৈতিক ও বেআইনি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাঠাচ্ছে মানুষ।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির আড়ালে আরও যারা এসব কাজ করছে তাদের ওপর কড়া নজরদারি চলছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এজেন্সির সই করা চুক্তিনামায় ভুক্তভোগীদের আইনি কোনো জটিলতা হতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, মামলা করেছেন ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর পরিবার। আমরা ভুক্তভোগীদের পাশে থেকে গাইড করবো এবং তারা আইনি সহায়তা পাবেন।
অভাব-অনটন বেশি থাকা এবং আয়-উপার্জনের সুযোগ কম থাকায় প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তারা যান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে এবং গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা কেন? ২০১৯ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? সম্ভবত না। আর সে কারণেই নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা নারী কর্মীর সংখ্যা শুধু বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও সরকার করে না। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৮
আপনার মতামত জানানঃ