সরকারি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক দুর্নীতি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। বাড়তি খরচ না করলে নাগরিকরা যেমন কোনো সেবা পান না, তেমনি কোনো প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে পারে না সরকার নিজেও। আর্থিক লেনদেনের ভাগবাটোয়ারা সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান পায় না। যারা এগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তারাই অর্থ নয় ছয়ের সুযোগ পাাচ্ছেন যুগের পর যুগ। বিনামূল্যের সেবা নগদ অর্থ দিয়ে গ্রহণ কিংবা ৪ হাজার টাকার বালিশ ১৭ হাজার টাকায় কেনা কিংবা অবৈধ কমিশন বা ঘুষ লেনদেনের বাড়তি অর্থের গন্তব্য কোথায়?
বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, হোটেল-রিসোর্ট, ব্যাংক-ব্যালান্স, জায়গা-জমিতে দৃশ্যমান কোটিপতি কারবারিদের; কিন্তু শত কোটি বা হাজার কোটির মালিকদের তথ্য চোখে পড়ে না খুব একটা। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এসব প্রভাবশালীদের বসবাস কানাডার বেগম পাড়ায়, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি কোনো দেশে। কাগজে-কলমে এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো তথ্য নেই; কিন্তু বাড়ি-গাড়ি আছে, আছে বিদেশে ব্যবসা এমনটি নিজেরাও প্রচার করে থাকে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বা এসএনবির ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ।
এতকিছুর পরেও ক্ষমতাসীন সরকারকে এবিষয়ে নীরব ভূমিকায় দেখা যায়। কখনোবা চাইছেন বিষয়টি এড়িয়ে যেতে। কখনোবা এসব না জানার ভাণ করে থাকতে দেখা গেছে।
প্রথম আলোর সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে সরকার জোরালোভাবে দেশের মানুষকে আশ্বাস দিয়েছিল যে আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে। আর পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক থেকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর থেকে প্রতিবছরই সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ভিন্ন বক্তব্য দেওয়া শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। ওই বছরের ১১ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ৩০০ ধারায় বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের সংবাদ আসলে অতিশয়োক্তি।’
এরপর বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১ সালের ৭ জুন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন, আমাদের দিন।’
আর সর্বশেষ গত ১০ জুন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’
দেখা যাচ্ছে, সরকার আসলে পর্যায়ক্রমে সুইস ব্যাংকসহ টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে ক্রমশ পিছু হটেছে। কেন সরকারের এই উল্টো পথে যাত্রা এ নিয়ে নানা কথা বলা হয়। তবে সুনির্দিষ্ট একটি উত্তর পাওয়া গেল গতকাল বুধবার।
বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড গতকাল বলেছেন, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে—এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ আয়োজিত ডিকাব টকে তিনি এসব কথা বলেন।
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে—এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য চায়নি।’
নাতালি চুয়ার্ড বিষয়টি নিয়ে বলেন, ‘তথ্য পেতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে আমরা সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্যের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করা হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব এবং সেটি তৈরি করতে হবে। এটি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছি।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশিরা কত টাকা জমা রেখেছে ওই তথ্য প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দিয়ে থাকে এবং ওই অর্থ অবৈধপথে আয় করা হয়েছে কি না, এটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’
নাতালি চুয়ার্ডের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা তো দূরের কথা, সুইস ব্যাংক থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাই বাংলাদেশ কখনো করেনি। যদিও আমরা জানি বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে ঠিকই আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। আসলে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামে সুইস ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে, যা চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এর আওতায় কেউ যদি নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে সেই তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো। এই ১২১ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।
এদিকে অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে দেশের হাইকোর্টও উদ্বিগ্ন। সুইস ব্যাংকে অবৈধ পথে বাংলাদেশিরা যেসব অর্থ জমা রেখেছেন বা পাচার করেছেন সেসব বিষয়ে সরকার এবং দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটি জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দুদকের কাছে এ প্রশ্ন রাখেন।
প্রকাশিত সংবাদের রেফারেন্স টেনে আদালত জানতে চান কী পরিমান অর্থ সুইচ ব্যাংকে পাচার হয়েছে এবং এ বিষয়ে সরকার ও দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বা দুদক কোনো তথ্য দিতে পারেনি আদালতকে। তাই আগামী রোববারের মধ্যে এ বিষয়ে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা হাইকোর্টকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ ও সম্পদ পাচার করে বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলার প্রবণতা নিকট অতীতে বেড়েছে। পাচার হওয়া সম্পদের অধিকাংশই দুর্নীতি ও অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জিত। অর্থ ও সম্পদ পাচারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে উপরের সারিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি দেশের সম্পদ পাচার হওয়ার ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা। কী পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে, সে হিসাব জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধ পথে অর্থ ও সম্পদ পাচার করেছে, তা ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ, স্বীকার করি। কিন্তু তাদের নামধাম ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করতে বাধা কোথায়?
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অর্থ পাচারকারীদের ব্যাপারে অনুসন্ধান ও তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের গুরুতর ঘাটতি আছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, অর্থ পাচারকারীরা প্রভাবশালী, তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো সংস্থা ব্যবস্থা নিতে চায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১১
আপনার মতামত জানানঃ