তেলের দাম বৃদ্ধি সব দেশে সব সরকারের জন্যই একটি কঠিন পদক্ষেপ। কারণ এতে ব্যাপক জন অসন্তোষের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার এক লাফে তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে মধ্যরাতে। কার্যকর হয়েছে মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে। এটা মানুষকে হঠাৎ করে বিপদের মধ্যে ফেলেছে। কেউ কোনো প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পায়নি। যে গাড়িটি খুলনা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় রওনা দিয়েছে, যার পথিমধ্যে তেল কেনার কথা ছিল, সে হঠাৎ করেই পাম্পে গিয়ে দেখেছে তেল বিক্রি বন্ধ। কারণ তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পাম্পগুলো তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয়।
করোনা ভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা ধরনের মূল্যবৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষের জীবন আগে থেকেই ওষ্ঠাগত। এর মধ্যে তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার সেই সংকট তীব্র করার পথে কেন হাঁটল? মূলত তিনটি কারণ এর পেছনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। যে কারণে ঝুঁকির পরোয়া না করেই সরকার তেলের দাম বেশুমার বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রথম কারণ
তেলের বর্তমান চাহিদা হ্রাস। দেশে স্বাভাবিক যে পরিমাণ জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে, সরকার এ মুহূর্তে তার যোগান দিতে সক্ষম নয়। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রির সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন জানিয়েছে, গত অর্থবছরে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে তারা। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ছিল ডিজেল। প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার যদি আগের বছরের হারেই জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তাহলে বাড়তি দামের কারণে ব্যাপক ডলার দেশের বাইরে চলে যাবে। এটা সরকার ঠেকাতে চাইছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের তথ্য সত্যি হলে ডলারের এমন সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ মন্তব্য করেছে যে, সরকার যে পরিমাণ রিজার্ভের কথা বলে বাস্তবে তা নেই। কাগজে কলমে রিজার্ভের হিসাবের তুলনায় বাস্তবে সরকারের হাতে কত রিজার্ভ রয়েছে তা অজানা। তবে সরকার যে ডলার সংকট এড়াতে মরিয়া, এটা পরিষ্কার। কয়েক মাস ধরেই অঘোষিতভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ব্যবসায়িদের খুলতে দেয়া হচ্ছে না এলসি।
এ অবস্থায় ডলার দিয়ে কেনাকাটা যত কম করা যায় তার উপায় খুঁজছে সরকার। জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে সরকারের অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু মানুষ যদি তেল না পায় তাহলে নতুন ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। সরকার সেই দায় কাঁধে নিতে চায় না। বিকল্প হিসেবে চাণক্য নীতি অনুসরণ করে জ্বালানির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির পথে হাঁটল সরকার। এত দাম হওয়ার কারণে এখন অনেকের জ্বালানি তেল কেনার সামর্থ্য থাকবে না। অনেক মানুষ নিজে থেকেই জ্বালানি তেল ব্যবহার কমিয়ে দেবে। এতে করে বাজারে জ্বালানি তেলের চাহিদা এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের তথ্য সত্যি হলে ডলারের এমন সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ মন্তব্য করেছে যে, সরকার যে পরিমাণ রিজার্ভের কথা বলে বাস্তবে তা নেই। কাগজে কলমে রিজার্ভের হিসাবের তুলনায় বাস্তবে সরকারের হাতে কত রিজার্ভ রয়েছে তা অজানা।
বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে আগেই। কিন্তু জেনারেটর চলছে ব্যাপক হারে। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন জেনারেটর চালানোর হার কমে যাবে। পরিবহনসহ নানা খাতে ব্যবহারকারীরা নিজেরাই তেল সাশ্রয়ের দিকে মনোযোগ দেবে। সরকারের এই নীতিকে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেছেন। সরকারের এই পদক্ষেপ রোগীকে হত্যা করে রোগ নির্মূল করার মতো। মানুষ যেন তেল না কিনতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে তেলের চাহিদা কমিয়ে আনছে সরকার।
দ্বিতীয় কারণ
আরো মুনাফা আদায়। সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে গেছে। চাপে পড়ে গেছে সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ী শ্রেণীও। এ অবস্থায় সরকারি কর্মকাণ্ডে গতি আনা এবং ব্যবসায়ীদের মুনাফার সুযোগ করে দিতে অর্থনীতিতে নতুন পুঁজির সঞ্চালন প্রয়োজন। সরকার তাই এক ধাপে জ্বালানির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি করে দিয়েছে। যাতে এই খাত থেকে ব্যাপক হারে মুনাফা তোলা যায়।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সরকার জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোনো ভর্তুকি দিতে চায়নি, বরং আরো মুনাফার চাপ দিয়েছে। তিনি বলেছেন, জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে “সরকার থেকে ভর্তুকি নেওয়া হচ্ছে না, বরং রাজস্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি কমানোর বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তারা সম্মত হয়নি। যদি কিছুটা কমানো যেত আর বাকিটা দামের সঙ্গে সমন্বয় করা হতো; তাহলে এত পরিমাণে দাম বাড়ানো হতো না।” সেইসঙ্গে আরো জানিয়েছেন সরকারের চাপের কথা। তার ভাষায়, “সরকারকে রাজস্ব দিতে হয়, সেখানেও বকেয়া আছে। এনবিআর পাওনা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। বিপিসি বড় ধরনের চাপে পড়ে গেছে।”।
অথচ জ্বালানি খাতে গত ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুযোগে বিপিসি ভোক্তাদের কাছ থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এখন মাত্র আট হাজার কোটি টাকার ক্ষতি দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ বাড়ানো হলো। বিশ্ব বাজারেও এই মুহূর্তে তেলের দাম পড়তির দিকে। যার অর্থ হলো, বাস্তবে জ্বালানি খাতে এখন লসের কোনো সুযোগ নেই। আর আগের লাভ থেকে সমন্বয় করা হলেও অনেক টাকা উপরি পড়ে থাকে। মূল্যবৃদ্ধির কোনো প্রয়োজনই পড়ে না।
কিন্তু এসব স্পষ্ট হিসাব সত্ত্বেও সরকার জ্বালানির ব্যাপক দাম বৃদ্ধির পথ থেকে সরে আসেনি। এ থেকে পরিষ্কার যে, সরকার জ্বালানি খাত থেকে আরো মুনাফা চায়। আগের চেয়েও বেশি মুনাফা নিতে বর্তমান আন্তর্জাতিক সংকটকে সরকার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এমন আচরণ বিদেশি দখলদারদের মতো। এরকমটা কেবল ঔপনিবেশিক কাঠামোতেই দেখা যায়। বর্তমান সরকার পাকিস্তান ও ব্রিটিশ আমলের দখলদারদের মতোই আচরণ করছে গণমানুষের সঙ্গে।
তৃতীয় কারণ
ঋণ পেতে আইএমএফের শর্ত পালন। বর্তমান সংকট সমাধানে সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, আইএমএফের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদে কম সুদের ঋণ নেয়া। যে ঋণে অন্তত বছর দুয়েকের গ্রেস পিরিয়ড থাকে। গ্রেস পিরিয়ড দুই বছরের অর্থ হলো ঋণ নেয়ার পর প্রথম দুই বছর কোনো সুদ দিতে হবে না। এ ধরনের একটি ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ লুটপাটের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী মহলের যোগসাজশে সরকার একের পর এক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেগুলো অব্যাহত রাখতে নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা দরকার।
এদিকে সরকারের আগের নেয়া অনেক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ। এগুলোর সুদ দেয়ার সময় চলে এসেছে। এরকম অবস্থায় শুরু হয়েছে ডলার সংকট। এখন রিজার্ভ থেকে এগুলো শোধ করতে গেলে রিজার্ভ তলানিতে নেমে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। যা কিনা দেশে আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকেও অনুৎসাহিত করবে। অর্থনীতির ওপর চতুর্দিক থেকে এরকম সব চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় চীনের স্বল্পমেয়াদি ঋণ সংকট সমাধানে কোন সুবিধা দেবে না। দরকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। যা দিতে পারে কেবল আইএমএফ। কারণ পুঁজিবাদী দেশগুলোর সংকট থেকে উত্তরণে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার তহবিল ও নীতি কেবলমাত্র এই সংস্থাটিরই রয়েছে।
কিন্তু আইএমএফের ঋণের সমস্যা হচ্ছে, তারা বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য অর্থনীতিকে সংস্কার করার শর্ত দেয়। এই শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলে ঋণ বাতিল হয়ে যায়। শঙ্কা থাকে আন্তর্জাতিক আদালতের মারপ্যাঁচের মধ্যে পড়ার। আইএমএফের নীতি হল ছোট দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য ব্যবসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এসব দেশে মানুষের গড় আয় বেশি বিধায় জ্বালানির দাম বা সাধারণ সেবা খাতগুলোতে প্রত্যক্ষ ভর্তুকি নেই। কিন্তু অপেক্ষাকৃত গরিব বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ মানুষ পিছিয়ে থাকায় সরকার নানা খাতে ভর্তুকি দেয়। যে কারণে এসব দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ধনী দেশের ব্যবসায়ীদের চেয়ে খানিক কম দামে পণ্য উৎপাদন করতে পারে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় কিছু সুবিধা পায়। আইএমএফ এটা হতে দিতে চায় না।
সরকার এ মুহূর্তে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে চাইছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, আইএমএফ এই ঋণ দিলে অবশ্যই তার নীতি অনুসারে শর্ত জুড়ে দেবে। আর সেই শর্ত পালনের অংশ হিসেবেই সরকার জ্বালানিতে ভর্তুকি দেয়ার নীতি থেকে সরে এসে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সরকার যদি অযৌক্তিকভাবে প্রকল্প গ্রহণ না করত এবং আগে ওসব ঋণ না নিত, তাহলে আজ এই ঋণ নেয়ার দরকার পড়োত না। এখন এই ঋণ নিয়ে মানুষের কাঁধে ঋণের বোঝাকে আরো বাড়াবে। আর ঋণের শর্ত হিসেবে মানুষের ওপর মূল্যবৃদ্ধির বোঝাও চাপানো হলো। সব দিক থেকেই মানুষের ওপর সংকট চাপিয়ে দিল সরকার।
আপনার মতামত জানানঃ