নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালানো শুরু করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এরই মধ্যে পুলিশের হাতে বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে।
নোয়াখালীর ভাসানচরে বর্তমানে সেখানে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। কক্সবাজারের তুলনায় উন্নত বাসস্থান আর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। তা সত্ত্বেও ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে পালাচ্ছে।
ভাসানচরের রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ কেন্দ্রকে ঘিরে দেশি-বিদেশি পাচারকারীরা সক্রিয় রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা পালালেও পরবর্তীতে আবার বেশ কিছু পরিবার ভাসানচর আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ফিরে আসে। সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান সত্বেও রোহিঙ্গাদের পলায়নে খোদ প্রশাসনও বিব্রত। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের পলায়ন রোধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন জেলার সচেতনমহল।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি রয়ে গেছে এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে পালিয়ে গেছে। আবার দেশি-বিদেশি সংঘবদ্ধ পাচারকারীদের যোগসাজসে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। এ কাজে পাচারকারীদের একাধিক নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জড়ো করে ট্রলার যোগে মালয়েশিয়া পাচারের খবরও শোনা যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গা পাচারে ভাসানচরে একটি চক্র জড়িত রয়েছে। এছাড়া হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জে পাচারকারীদের এজেন্ট রয়েছে। এরা ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গাদের পলায়নে সহযোগীতা করছে।
জানা যায়, গত দুই বছরে ভাসানচর আশ্রয়ণ কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে যায়। এর মধ্যে নোয়াখালীর সূবর্ণচর, হাতিয়া ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় জনগণ পলায়নরত ৫৫ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে ভুল বুঝতে পেরে আবার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে ফিরে আসে বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার। এছাড়া ২০২১ সালের ১৪ আগস্ট রাতে ভাসানচর থেকে ৪১ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষ পালানোর সময় সাগরে প্রবল স্রোতে ট্রলারটি ডুবে যায়। এসময় সমুদ্রে মাছ ধরার অন্য ট্রলারের জেলেরা ১৪ জনকে উদ্ধার করলেও অবশিষ্ট ২৭ জন জোয়ারে ভেসে যায়।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা এবং ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, মূলত স্থানীয় মাঝ ধরা ট্রলার বা নৌযানে করেই পালানোর ঘটনা ঘটছে।
কক্সবাজারে ফেরা ওই রোহিঙ্গা নারীর বিবরণে ভাসানচর থেকে প্রথমে লুকিয়ে মাছধরা নৌকায় তারা নোয়াখালী পৌঁছান।
এরপর নোয়াখালী থেকে বাসে করে চট্টগ্রাম হয়ে তাদের গন্তব্য ছিল কক্সাবাজার।
সর্বশেষ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ভাসানচর থেকে এই রুটে পালানোর সময় একাধিক গ্রুপ এরই মধ্যে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে।
কেন পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা?
এদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই প্রবণতা কেন তৈরি হলো – সেটি বোঝার জন্য ভাসানচরে অবস্থানরত কয়েজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় বিবিসির সঙ্গে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা জানান, রোহিঙ্গাদের পাচার করতে একটি দালাল চক্র তৈরি হয়ে গেছে। এরা স্থানীয় মাছ ধরা নৌকার মাঝিদের সঙ্গে যোগসাজসে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন রূটে পালাতে সহায়তা করছে।
কক্সবাজারের তুলনায় উন্নত বাসস্থান আর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। তা সত্ত্বেও ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে পালাচ্ছে।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়া যাবার পথে উদ্ধার করে যাদের প্রথম ভাসানচরে নেয়া হয়, তাদের মাধ্যমেই এই প্রবণতা শুরু।
“আমার ধারণা এ পর্যন্ত চার থেকে ৫শর মতো হবে আনুমানিক। বেশিরভাগ পালাইছে মালয়েশিয়ার গ্রুপ। ওদের দিয়ে পালানোর উদ্বোধন হইছে,” বলেন ওই রোহিঙ্গা।
তিনি বলেন, “ওদের যখন আমাদের মধ্যে ছেড়ে দিছে- ওদের মা বাবারা, স্বামীরা সন্দীপ নোয়াখালী দিয়ে ট্রলার পাঠিয়ে নিয়ে গেছে। আর কিছু ব্যাচেলর আছে ওরা পালাইছে।”
ভাসানচরের বসবাসরত এই রোহিঙ্গা নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম পরিচয় গোপন রেখেছেন।
ওই ব্যক্তি তুলে ধরেছেন, কক্সাবাজারের চেয়ে উন্নত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্বেও রোহিঙ্গারা কেন পালাচ্ছেন।
তার কথায়, ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা অংশ আয় রোজগার কমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া অনেকে মা-বাবা পরিবার-পরিজন কক্সবাজারে থাকার কারণে তারা সেখানে ফিরে যেতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
একটা শ্রেণী আছে যারা দ্বীপের মধ্যে মানসিকভাবে নিজেদের বন্দী বলে মনে করছেন।
“ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য রয়েছে উন্নত বাসস্থান এবং নানা সুযোগ সুবিধা আমাকে এক লাখ টাকা দিলেও আমি পালাবো না। কিন্তু কিছু লোক এখানে কক্সবাজার থেকে এসেছে বিশৃঙ্খলা করার জন্য। চার মাস হয়ে গেছে বসে আছে। হাতে কোনো টাকা নাই। ইনকাম নাই। চার দোকানে গিয়ে নাস্তা করতে পারে না। প্রয়োজন মতো কিছু কিনতে পারে না।”
“কিছু সিঙ্গেল ব্যাচেলর লোক আছে, মা বাবা ছাড়া আসছে। কতগুলো স্বামী থেকে গেছে, বউ চলে আসছে। কিছু বেকার ছেলে আছে, পড়াশোনা জানা কোনো কাজ পাচ্ছে না। কবে হবে, কবে সুযোগ আসবে – এটা বলে বলে আর সহ্য করতে পারছে না। এরকম মন-মানসিকতা নিয়ে চলে যাবার কথা বলতেছে”।
ভাসানচরে নবগঠিত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সেখানে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে তারাও রোহিঙ্গাদের পালানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তবে এ পর্যন্ত কত সংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়েছেন সেটি সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাতিয়ার উপজেলা মূল ভূখণ্ডের ২০ কিলোমিটার পূর্বে বিশাল আয়তনের ভাসানচরে ১৩ হাজার একর জমির উপর রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ কেন্দ্র নির্মিত হয়। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এক লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় ১২০টি গুচ্ছগ্রামসহ যাবতীয় অবকাঠামো। দেশি-বিদেশি দাতাগোষ্ঠী, পর্যবেক্ষক ও প্রশাসনের উদ্যোগে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গার প্রথম দলটি ভাসানচর আগমন করে। বর্তমানে ভাসানচরে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
উল্লেখ্য, ভাসানচরে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছে আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও পুলিশ বাহিনী। হাতিয়া চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ভাসানচর যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সী-ট্রাক। নৌপথ ও দায়িত্বে থাকা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের নজরদারির কারণে বাইরে থেকে যে কেউ ভাসানচরে সহজে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু গভীর সমূদ্রে মাছধরা ট্রলারের জেলেরা ভাসানচরের বিভিন্ন ঘাটে যাত্রা বিরতি করে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ভাসানচর থেকে মাছ ধরার ট্রলারে রোহিঙ্গারা পালিয়ে থাকে। বিশেষ করে ভাসানচর থেকে সমুদ্র পথে চট্টগ্রামের দূরত্ব বেশি থাকার কারণে হাতিয়া চেয়ারম্যান ঘাট, হরণী-চানন্দি ইউনিয়ন এবং সন্ধীপ চ্যানেল দিয়ে চর এলাহীর ভাবনী নদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ রুট ব্যবহার করছে।
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানায়, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্বেও ভাসানচর থেকে কিছু রোহিঙ্গা পালিয়েছে। অনেকে পরে ভুল বুঝতে পেরে আবার আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরেও এসেছে। পালানো রোধে প্রশাসনের উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভাসানচরের আশপাশের নৌরুটে চলাচলকারী মাছধরার ট্রলারগুলোর গতিবিধি ওপর নজরদারি করা হবে। ভবিষ্যতে ভাসানচর থেকে পালানো রোধকল্পে প্রশাসনের উদ্যোগে সর্বাত্নক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৯
আপনার মতামত জানানঃ