ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেছে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। গত ১৯শে জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উপদেষ্টা ভ্যালেরিও বালজামো এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ম্যানেল মসালমির সহায়তায় ইপিপি গ্রুপ এবং পার্লামেন্ট সদস্য ও হোস্ট ফুলভিও মার্তুসিলো কর্তৃক “বাংলাদেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন” শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এমন আহ্বান জানানো হয়।
দ্য ইউরোপীয়ান টাইমস এ খবর নিশ্চিত করে জানায়ঃ পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর কথা বলতে ইইউ প্রতিনিধিদলের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের পাশাপাশি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রতিনিধিদলটি শ্রম অধিকার নিয়ে আলোচনা করেছিল। ইউরোপ প্রবাসী বাঙালিদের উপস্থিতিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র প্রধানত আসন্ন নির্বাচন এবং সংখ্যালঘুদের বিষয়ে আলোচনা করেন।
সংস্কৃতি ও শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে পার্লামেন্ট সদস্য অ্যাডিনলফি ২০২১ সালে বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিষয়টিতে মনোনিবেশ করেন যা সত্যিই উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং দেশটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা করা প্রয়োজন।
পার্লামেন্ট সদস্য ভুওলো ইউরোপীয় পার্লামেন্টের রেজুলেশনগুলোর কথা উল্লেখ করেন যেগুলোতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল কর্তৃক ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবাধিকারের পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা রয়েছে। জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বীকৃতি, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইন প্রনয়ণ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশকে যে ৫০০ টিরও বেশি সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলোর চিত্র এর মাধ্যমে ফুটে উঠে।
পার্লামেন্ট সদস্য গানসিয়া এই সত্যের উপর জোর দেন যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। স্থানীয় ও জাতীয় উভয় নির্বাচনই অত্যন্ত বিতর্কিত, কারচুপি ও সহিংসপূর্ণ হয়েছে। দেশের সংখ্যালঘুরা প্রতিদিন তাদের নিরাপত্তা ও স্বার্থের দিক থেকে হুমকির সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই সাহসিকতা এবং দৃঢ়তার সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাতে হবে।
বাঙালি এবং ইউরোপ প্রবাসী প্রতিনিধিরা নিজ দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বেলজিয়াম প্রবাসী বাঙালিদের সভাপতি এবং মানবাধিকার কর্মী সাইদুর রহমান বলেন, বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতারা ক্রমাগত হুমকির সম্মুখীন।
তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবিলম্বে মুক্তি এবং অবাধ নির্বাচনের আহ্বান জানান যাতে সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশে ইইউ প্রতিনিধিদল কর্তৃক শ্রমিকদের আরো বেশি অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকারের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার বিষয়টির ওপর জোর দেন। তিনি বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহবান জানান।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালি প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করেন।
পার্লামেন্ট সদস্য ফুলভিও মার্তুসিয়েলো বলেন, ইইউ বাংলাদেশের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেন, প্রধানত হিন্দু সংখ্যালঘুরা নিপীড়ন এবং ক্রমাগত হামলার মুখোমুখি। তিনি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আহ্বান জানান যাতে সকল সম্প্রদায়, রাজনৈতিক দল এবং মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
সেমিনারের পর একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে ইউরোপ প্রবাসী বাঙালি এবং বিভিন্ন সংগঠন প্যানেলের কাছে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং প্রধানত ২০২৩ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জরুরি প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করেন।
এখানে আসকের একটি প্রতিনেদন তুলে ধরা যায়। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালকে মানবাধিকার ‘লঙ্ঘনের’ বছর হিসেবে উল্লেখ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। সংগঠনটি বলছে, মানবাধিকার পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যা সহ্যক্ষমতার বাইরে। এটিকে বর্বরতাও বলা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন। তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন ৫১ জন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে একজন এবং একজন গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন।
আসকের তথ্য বলছে, গত বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন ৭ জন। তাদের মধ্যে পরে ৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও ১ জন এখনো নিখোঁজ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে হেফাজতে ইসলামের ডাকা বিক্ষোভ ঘিরে সহিংসতায় অন্তত ১৪ জন নিহত হন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৬ জনসহ মোট ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় গত বছর ২৭০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। আর গত বছর অন্তত ২০ বার দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারির ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া, হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন গত বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ারদীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ, মন্দির, ঘরবাড়ি ও দোকানে হামলা–ভাঙচুরের বিষয়টিও মানবাধিকার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে আসক। তাদের তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই সময় ৯ জন (চাঁদপুরে ও ফেনীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ৬ জন) নিহত হন। তখন রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬৫টি বসতঘরে হামলা–ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।। এ ছাড়া বছরজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলায় ২০৪টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ