দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বর্তমানে কঠিন সংকট মোকাবিলা করছে। জ্বালানি সংকটের কারণে হচ্ছে না পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে সারা দেশে দিনে রাতে দফায় দফায় চলছে লোডশেডিং। বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ সার কারখানার উৎপাদন। উৎপাদন সীমিত করতে হয়েছে নানা ধরনের শিল্পকে। গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও ১০ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং চলছে বিধায় কৃষি উৎপাদনও বিপর্যয়ের মুখে। সরকারের কঠোর নির্দেশে সূর্যাস্তের প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে সব ধরনের দোকানপাট। মোটকথা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন, বেচাকেনা, গৃহস্থালী জীবন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, সব কিছুই চরম দুর্দশায়।
সরকার যেখানে চাহিদার চেয়েও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে, সেখানে আজ কেন ঘরে ঘরে লোডশেডিং- এটা সবার মনেই বড় একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুতের গড় চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াট। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এই হিসেবে বাড়তি বিদ্যুৎ থাকার কথা। কিন্তু চলছে লোডশেডিং। সরকার বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বড় সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না ব্যয়বহুল জ্বালানি খরচের কারণে। তবে সরকারের এই অভিযোগ সঠিক নয়।
আজকের লোডশেডিংয়ের কারণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের অপরিণামদর্শী নীতি বাস্তবায়ন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে ক্ষমতায় আছে বিগত ২০০৯ সাল থেকে, টানা প্রায় ১৪ বছর হতে চলল। এই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার এমন কিছু নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে এবং এখনো করে চলেছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনকে করে তুলেছে ব্যয়বহুল। ইউক্রেন সংকতের অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত যথেষ্ঠ ব্যয়বহুল। গোড়া থেকেই সরকারের নীতি হলো, ব্যয়বহুল, আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত গড়ে তোলা। কিন্তু এটা না করে সরকার যদি টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত গড়ার নীতি ও কৌশল গ্রহণ করত, তাহলে আজ ইউক্রেন যুদ্ধ কোনো সংকট তৈরি করতে পারত না।
সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সংকট চলছিল। দিনে-রাতে লোডশেডিংয়ে মানুষ ছিল দুরবস্থায় জর্জরিত। সরকার বিদ্যুতের এই সংকটকে সমাধানের পরিবর্তে এই সংকট কাজে লাগিয়ে সুবিধা লাভের নীতিতে এগিয়ে চলে। ‘যত টাকা লাগুক, যেভাবে হোক আমরা বিদ্যুৎ চাই’। সরকার এমন নীতি ঘোষণা করে এবং এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এতে বিদ্যুতের দামও বেড়েছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে। যত টাকা লাগুক বলে, যে বিদ্যুৎ অল্প টাকায় কেনা সম্ভব ছিল, সেটা কেনা হয়েছে কয়েকগুণ বেশি দামে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল নাম দিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে এই লুটপাট নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ নবায়ন করা হয়েছে। যদিও নতুন মেয়াদে ক্যাপাসিটি চার্জ শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসার কথা, তখন খরচ শুধু রক্ষণাবেক্ষণ তথা মেইনটেনেন্সের। কিন্তু তারপরও উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ বজায় রাখা হয়েছে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই উদ্যোক্তাদের লাভের কথা মাথায় রেখে।
ক্যাপাসিটি চার্জের গোমরটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। রেন্টাল নামক বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে একটা কথা চালু আছে, ‘চললে লাভ, না চললে বেশি লাভ’। কারণ বিশাল ব্যয়ের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরকার চুক্তি করে স্বল্পমেয়াদে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের খরচ দৈনিক মেয়াদে অনেক বেশি পড়ে। ধরুন, ৭৫ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে খরচ হলো ১০০ কোটি টাকা। ১ হাজার দিন বা প্রায় ৩ বছর এটি চলবে বলে চুক্তি করা হলো। তাতে করে দৈনিক স্থাপন ব্যয় পড়ে ১০ লাখ টাকা। চুক্তিতে বলা আছে, এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য তেলের জোগান সরকারকেই দিতে হবে। না দিতে পারলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকবে এবং দৈনিক এই স্থাপন ব্যয়, যাকে কিনা বলা হয় ক্যাপাসিটি চার্জ, তা সরকারকেই পরিশোধ করতে হবে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক এর দায় নেবে না।
দীর্ঘমেয়াদে এই লুটপাট নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ নবায়ন করা হয়েছে। যদিও নতুন মেয়াদে ক্যাপাসিটি চার্জ শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসার কথা, তখন খরচ শুধু রক্ষণাবেক্ষণ তথা মেইনটেনেন্সের। কিন্তু তারপরও উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ বজায় রাখা হয়েছে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই উদ্যোক্তাদের লাভের কথা মাথায় রেখে। এর বিরুদ্ধে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। জরুরি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের প্রণীত দায়মুক্তি আইনের কারণে এসব অন্যায় সিদ্ধান্তকে আইনীভাবেও চ্যালেঞ্জও করা যায়নি। এভাবে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে গত ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছররে বেসরকারি খাতে ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। এর মধ্যে ১২ কোম্পানির পকেটে গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সরকার নিজে করলে এত ব্যয় হতো না এবং রেন্টালেরও নানা বিকল্প ছিল। কিন্তু এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছিল কার্যত সরকারের পছন্দের পুঁজিপতিদের পকেট ভারী করার জন্য। এই মালিকরা কারা তা পরবর্তীতে ভিন্ন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে। এখানে যেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সরকার সুবিধা লোটার উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ খাতকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। এসব টাকা সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো ব্যক্তিগত টাকা নয়, এগুলো জনগণেরই টাকা। জনগণের ওপর নানা ধরনের চার্জের নামে বাড়তি দাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ জ্বালানির উচ্চমূল্য দিতে দিতে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। এই টাকা যদি আজ বিদ্যুৎ খাতে জমা থাকত, তাহলে আজ জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে অস্থির হয়ে পড়তে হতো না। জ্বালানি খাতকে সরকার আপৎকালীন ভর্তুকি দিতে পারত এবং বিদেশ থেকে বেশি দামে জ্বালানি কিনলেও এর জন্য চাপ তৈরি হত না।
অন্যদিকে বিগত দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেটস নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থানের সুবাদে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যায়। বাংলাদেশে এ সময় তেলের দাম কমানো হয়নি। মূল্য সমন্বয় করা হয়নি। সরকারি খাতে এ সময় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন কম দামে জ্বালানি কিনে বেশি দামে বিক্রি করেছে। বেসরকারি খাতের মালিকরা ইচ্ছেমতো মুনাফা লুটেছে। কিন্তু সে সময় পরিকল্পিতভাবে তেল মজুদের ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হলে আজ বাড়তি তেল থাকত। বাড়তি তেলের সেই মজুদ দিয়ে সংকট মোকাবিলা করা যেত। সে সময় মুনাফার প্রয়োজনে বাড়তি মূল্যের চাপ জনগণের উপর না চাপানো হলে আজ আপৎকালীন সময়ে খানিক দাম বৃদ্ধি করা হলেও মানুষ তা সয় করতে পারত, মেনে নিত।
কোনো আপত্তি আমলে না নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা খাতে রিজার্ভ থেকে ঋণদান করেছে সরকার। ফলত এখন ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। কাগজে কলমে যে রিজার্ভ আছে বলা হচ্ছে, বাস্তবে সরকারের হাতে সে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেই বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।
সরকার বলছে, ডলার সংকট রয়েছে, তাই জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন এই ডলার সংকট। ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের ডলার সংকটের কারণ নয়। ২০২১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবার পর সরকার প্রচার করতে শুরু করল যে, রিজার্ভের সাগরে আমরা ভাসছি। এখন এই টাকাকে কাজে লাগাতে হবে। এরপর দেখা গেল, কোনো আপত্তি আমলে না নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা খাতে রিজার্ভ থেকে ঋণদান করেছে সরকার। ফলত এখন ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। কাগজে কলমে যে রিজার্ভ আছে বলা হচ্ছে, বাস্তবে সরকারের হাতে সে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেই বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের। যে কারণে সরকার বিভিন্ন খাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরসহ নানা ধরনের ব্যয় হ্রাসের কথাও বলছে।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, সরকার জ্বালানি খাতকে ব্যয়বহুল করে আগেই এমন একটা অবস্থায় নিয়ে গেছে যে, এটা যেকোনো সংকটের মুখে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থাতেই ছিল। সরকার জ্বলানি খাতকে মুনাফা লাভের হাতিয়ারে পরিণত করায় বিশেষ অবস্থায় চলার মতো এ খাতের নিজের কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। এর পাশাপাশি ডলারের রিজার্ভ নিয়ে অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল্যও আজ দিতে হচ্ছে। সরকার যদি জ্বালানি খাতের টেকসই বিকাশের পথে হাঁটত, তাহলে আজ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে উদ্বৃত্ত অর্থ ও মজুদকৃত জ্বালানি থাকত। কম দামের বিদ্যুতের ওপর কিছু বাড়তি মূল্য আরোপ করা হলেও সেটা এমন কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলত না। ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা অন্য যেকোনো সংকটকেই জ্বালানি খাত মোকাবিলা করতে পারত। কিন্তু আগে থেকেই চরম শোষণে পর্যুদস্ত জ্বালানি খাত ও এর ভোক্তারা এখন কোনো সংকট মোকাবিলার অবস্থাতেই নেই। এটা এই খাতে সরকারের মুনাফালোভী অবিবেচক নীতিরই কুফল।
আপনার মতামত জানানঃ