অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। এজন্য আগের অর্থবছরের মতোই ১ জুলাই শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরেও কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটছে সরকার।
করোনা মহামারি থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক বৈশ্বিক সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে বিশ্ববাসীকে। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সরকারের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। অন্যদিকে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেছে। একই সঙ্গে ডলারের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। কমে গেছে টাকার মানও।
সরকারের রাজস্ব আদায়েও বিরাজ করছে ধীরগতি। পরিস্থিতি বিবেচনায় ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকার অনেক পদক্ষেপও নিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যা করা হচ্ছে তা আর্থিক ভিত্তিতে৷ তাই কিছুটা ফল আসলেও খুব বেশি কাজে আসবে না৷ কারণ যথাযথ মনিটরিং পদ্ধতি নেই৷
অন্যদিকে রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে সরকার আমদানি ব্যয়ও কমাতে চাচ্ছে৷ এর ফলে চাপ পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়েছে৷ এখন সারাদেশে শিডিউল করে বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে৷ একইভাবে গ্যাসেরও রেশনিংয়ের চিন্তাভাবনা হচ্ছে৷
এর আগে সরকার গত ১২ মে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরতে খুব প্রয়োজন না হলে বিদেশ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ ২০ জুলাই সরকার আরো যে আটটি সিদ্ধান্ত নেয় তার মধ্যে রয়েছে সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, জ্বালানি খাতে সরকারের বাজেটের ২০ শতাংশ কম ব্যবহার, অনিবার্য না হলে শারীরিক উপস্থিতিতে সভা পরিহার করা, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ সফর পরিহার করা, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং, ভ্রাম্যমাণ আদলেতের মাধ্যমে মজুতদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি৷
বিদেশসফর
সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের লাগাম টানা যাচ্ছে না৷ চর দেখতে, মশলার চাষ শিখতে, মেডিকেল যান্ত্রপাতির প্রশিক্ষণ নিতে,পড়াশুনা করানো শিখতে বিদেশ সফর অব্যাহত রেখেছেন তারা৷
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৮ জন কর্মকর্তা মশলার চাষ শিখতে বিদেশে যাচ্ছেন৷ তারা ভারত, শ্রীলঙ্কা অথবা থাইল্যান্ডে যাবেন৷ এতে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৯০ লাখ৷ তবে যাওয়ার কথা ছিলো ৬৫ জনের৷ পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে সংখ্যা কমানো হয়েছে৷
এদিকে বাংলাদেশের চরের মানুষের উন্নয়ন কীভাবে করা যায় তা দেখতে যুক্তরাষ্ট্র ও অষ্ট্রেলিয়া সফরে যাচ্ছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০ জন সরকারি কর্মকর্তা৷ নয়জন এরইমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছেন৷ বাকিরা যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন৷ তাদের বিদেশ ভ্রমণের সরকারি আদেশ জারি হয়েছে৷
২০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তার বিদেশ সফরের একটি প্রকল্প এখন চলমান আছে৷ তারা শিশুদের পড়ানো শিখতে বিদেশ যাচ্ছেন৷ এই বিদেশ সফরে মোট খরচ হচ্ছে ৫৯০ কোটি টাকা৷
২০১৮ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়৷ করোনার আগে ৮২০ শিক্ষক-কর্মকর্তা বিদেশ ঘুরে এসেছেন৷ বাকিরা এখন পর্যায়ক্রমে যাবেন৷ আর সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করতে প্রশিক্ষণ নিতে ৪২ জন, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাকে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে৷ এতে খরচ ধরা হয়েছে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা৷
সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি
সরকারি কর্মকর্তাদের গড়ি বিলাস কমেনি৷ সরকারি একেকটি গাড়ির পিছনে সরকারের মাসে জ্বালানি তেলসহ ব্যয় হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা৷
উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারা ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণে নিয়ে গাড়ি কেনার পর তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা নেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়িও ব্যবহার করছেন৷ এতে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে৷
এসিকাণ্ড
সচিবালয়ে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকার পরও আরো দুই হাজার ৭০০ এসি আছে বিভিন্ন রুমে রুমে৷ এসি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নাই এরকম ৮০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর রুমেও এসি আছে৷ মোট সাড়ে ছয় হজার টন এসি আছে সচিবালয়ে৷
ঢাকায় একক সরকারি ভবন হিসেবে কমপক্ষে ১৩টি ভবন এসি বিলাসের জন্য এরইমধ্যে আলোচনায় এসেছে৷ তারমধ্যে রাজস্ব ভবনে দুই হাজার ৫০০ টন, পানি ভবনে দুই হাজার ৪০০ টন, অর্থ ভবনে এক হাজার ৫০০ টন, পুলিশ ভবনে এক হাজার ২০০ টন৷
প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তাদের এসির ব্যবহার কমিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এই গরমে স্যুট-কোট না পরার আহ্বান জানিয়েছেন৷ কিন্তু মন্ত্রীদের বৈঠকগুলোতে মন্ত্রী এবং কর্মকর্তাদের স্যুট-টাই পরা অবস্থায়ই দেখা যাচ্ছে৷ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতখেকো এসির ব্যবহার একটুও কমেনি৷
আর এই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের দৈনিক ভ্রমণ ভাতা ও বদলি ভাতা বাড়ানো হয়েছে৷ আর সরকারি কর্মকর্তারা নানা বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্যও যে ভাতা পান তা অব্যহত আছে৷ এদিকে উপজেলা পর্যায়ে সরকারি অফিসেও বিদ্যুৎ ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে৷ কিন্তু তার কোনো নীতিমালা জারি করা হয়নি৷ ফলে ব্যয় কমানো কোনো উদ্যোগ এখনো স্পষ্ট নয়৷
খরচ কি শুধু সাধারণ মানুষ কমাবে?
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দরিদ্র এবং প্রায় ২ কোটি মানুষ অতিদরিদ্র। উল্লেখ্য, করোনাকালে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনার প্রকোপ কমায় এ সংখ্যা কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে ২১ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে, নিম্নমানের পণ্য কিনছে বা একেবারে বাদ দিয়েছে। দেখা গেছে, ২৭ শতাংশ পরিবার কম পরিমাণ চাল কিনছে। আগের চেয়ে নিম্নমানের চাল কিনছে ৩৬ শতাংশ পরিবার। কোনো পরিবার একেবারে চাল কিনছে না, তেমনটা দেখা যায়নি। তবে পুষ্টির জন্য দরকারি মাছ, মাংস, দুধ কম কেনা বা একেবারে বাদ দিয়েছে।
দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে দুধের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। মান কমিয়ে দিয়েছে ২৫ শতাংশ। আর একেবারে বাদ দেওয়া সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো পরিবার। ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ মাছ কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কম কিনছে ৫৬ ভাগ।
জরিপে দেখা যায়, মাসে অন্তত এক দিন শহরের বস্তিবাসীর ৫ শতাংশ মানুষ তাদের আর্থিক দুরাবস্থায় সারা দিন অভুক্ত থেকেছে। গ্রামে এ অবস্থা ৩ শতাংশ। অন্তত একবেলা কম খেয়েছে, এমন পরিবারের সংখ্যা শহরে ২১ এবং গ্রামে ১৩ শতাংশ।
করোনার সময় এবং পরে আর্থিক অনটনের সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষ কী উপায় বেছে নিচ্ছে, তার চিত্রও উঠে আসে জরিপে। সেখানে গত বছরের আগস্টের সঙ্গে সাম্প্রতিক জরিপের তুলনা করা হয়। দেখা যায়, করোনার সময় যে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা ছিল দুই সময়েই তা কমে গেছে। আগস্ট মাসে ৯১ ভাগ মানুষ নিজের আয়ের ওপরই নির্ভর করে চলত। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯৩ শতাংশ। আগে দোকানে বাকি রেখে বা ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন তা কমে যাচ্ছে। গত আগস্টে ১৭ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়ে চলতে পারত। এখন তা হয়েছে ৭ শতাংশ। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে গেছে যে মানুষ আর ঋণ নিতে চায় না। এর কারণ, তা পরিশোধ তারা করতে পারবে না। শহরের বস্তির ৩১ শতাংশের ঋণ দরকার হলেও তারা তা নিতে পারছে না। ৫১ শতাংশ বলেছে, তারা আর ঋণ চায় না।
পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার খাদ্যবহির্ভূত নানা খাতে মানুষ তাদের ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে বা বাদ দিচ্ছে। ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা সন্তানদের জন্য ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। সন্তানের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করেছে ১০ শতাংশ। প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে ১১ শতাংশ ক্ষেত্রে।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭২৭
আপনার মতামত জানানঃ