ইহুদিদের নির্বাসনের শেষ দিকে এবং মেসিয়ানিক যুগের প্রথম দিকে গৌগ মাগৌগের একটি দুর্ধর্ষ যুদ্ধ সংঘটিত হবে। র্যাবাই (ইহুদি মোল্লা/পন্ডিত) ডেভিড কিমহির মতে, যুদ্ধটি হবে জেরুজালেমে। ইহুদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী, গৌগ মাগৌগের যুদ্ধ হবে ভালো ও মন্দের মধ্যে একটি চূড়ান্ত লড়াই যা চিরন্তন শান্তির সূচনা করবে।
এজিকিয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে ইহুদি সম্প্রদায়ে গৌগ মাগৌগের ধারণার সূত্রপাত হয়। তিনি গৌগকে একজন রাজপুত্র এবং তার দেশকে মাগৌগ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তবে মাগৌগ শব্দটি হিব্রু বাইবেলের জেনেসিস অংশে প্রথম লক্ষ্য করা যায়। সেখানে মাগৌগকে নবি নুহের পুত্র ইয়াফেসের একজন বংশধর হিসেবে অভিহিত করা হয়। সম্ভবত পূর্বে ইহুদি শ্রুতি ছিল ‘গৌগের মাগৌগ’। কিন্তু কালক্রমে তা ‘গৌগ মাগৌগ’-এ পরিণত হয়।
হিব্রু বাইবেলের মতো ঐতিহাসিক জোসেফাসও মনে করতেন, গৌগ জাতি নবি নুহের তৃতীয় পুত্র ইয়াফেসের উত্তরসূরি মাগৌগের বংশধর। তিনি তাদের সিথিয়ান (The Scythians) হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। সিথিয়ানরা ছিল উত্তর সাইবেরিয়ার এক যাযাবর বর্বর জাতি। তারা খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ মঙ্গলীয়দের গৌগ মাগৌগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাছাড়া ভাইকিং, হান, খাজার, তুনানিয়, এমনকি ইসরাইলের হারানো গোত্র- সব জাতিকেই বিভিন্ন সময়ে এই নামে ডাকা হয়েছে।
ডেড সি ক্রলেও গৌগ এবং মাগৌগ নাম দুটিকে পাওয়া যায়। কিন্তু তার প্রেক্ষাপট জানা যায় না। প্রাচীন র্যাবাই সাহিত্যেও এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। খ্রিষ্টানদের নিউ টেস্টামেন্টের Book of Revelation অংশে গৌগ মাগৌগ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। সেখানে তাদের অত্যাচারী জাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ কিংবদন্তিতে গৌগ মাগৌগ নামের এক দানবের উল্লেখ আছে। আবার কেউ কেউ মাগৌগ বলতে ব্যাবিলন অঞ্চলকে বুঝিয়ে থাকেন।
রোমানদের আমল থেকে এই কিংবদন্তি প্রচলিত হয় যে, আলেকজান্ডার বর্বর নরখাদক জাতির রাজা গৌগ এবং মাগৌগকে তাড়িয়ে এক পর্বতখাদের ওপারে পাঠিয়ে দেন। তিনি এমন এক প্রাচীর নির্মাণ করে দেন যেটা ভেদ করে তারা বের হতে পারবে না। সেই প্রাচীরকে বলা হয় ‘গেটস অব আলেকজান্ডার’।
খ্রিষ্টীয় সপ্ত শতাব্দীর প্রথম দিকে, সিরিয়াক ভাষার আলেকজান্ডার সম্পর্কিত কিংবদন্তি হতে জানা যায়, গৌগ এবং মাগৌগ হানদের রাজা ছিলেন। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত যাযাবর হান জাতির বসবাস ছিল মধ্য এশিয়া, ককেশাস এবং পূর্ব ইউরোপ অঞ্চলে। একজন খ্রিষ্টান ব্যক্তি সেই কিংবদন্তিটি লিখে রাখেন। সেটিই মূলত প্রথম লিখিত উৎস যেখান থেকে জানা যায়, গৌগ ও মাগৌগ প্রাচীরে বন্দি আছে এবং পৃথিবীর শেষ দিনগুলোতে তারা বেরিয়ে আসবে। কিংবদন্তি অনুসারে, আলেকজান্ডার এই প্রাচীরে খোদাই করে ভবিষ্যতের একটি তারিখ লিখেছিলেন, যেদিন প্রাচীরের ওপারের ২৪টি জাতি একত্রিত হয়ে প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসবে এবং পৃথিবীর বড়ো একটি অংশের দখল নিয়ে নেবে।
সপ্তম শতকের আরেক খ্রিষ্টীয় উৎস ‘সিউডো-মেথডিয়াস’ অনুসারে, আলেকজান্ডার দুই পাহাড়ের সরু পথে প্রাচীর নির্মাণ করে গৌগ মাগৌগকে আটকে দেন।
উল্লেখ্য যে, ইতিহাসে বর্ণিত আলেকজান্ডার উত্তরের বর্বরদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যে কাস্পিয়ান গেট নির্মাণ করেছিলেন, সেটাকেই সেই প্রাচীর হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কাস্পিয়ান গেটটি যে আসলে কোথায় বানানো হয়েছিল তা শতভাগ নিশ্চিতভাবে কোনো ঐতিহাসিক বলতে পারেননি। কিন্তু নির্মাণ করা হয়েছিল, এটা নিশ্চিত। রাশিয়ার ডারবেন্ট পাস, কিংবা কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিমে রাশিয়া এবং জর্জিয়ার মাঝের ডারিয়েল পাস, কিংবা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের গ্রেট ওয়াল অব গর্গান, যেকোনোটাই সেই প্রাচীর হতে পারে।
ইহুদি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, গৌগ মাগৌগ মুক্তি পাওয়ার আগে নবি ইলিয়াহু পৃথিবীতে ফেরত আসবেন। এসময় দুজন মেসিয়ার আগমন ঘটবে। তাদের প্রথমজন হবেন ইউসেফের বংশের এবং দ্বিতীয়জন হবেন ডেভিডের বংশের। ইউসেফের বংশ থেকে যিনি আসবেন তিনি গৌগ মাগৌগের যুদ্ধে মারা যাবেন। নবি জাকারিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, তার মৃত্যুতে জাতীয় শোক নেমে আসবে। হিব্রু বর্ষপঞ্জির তিশরি মাসে যুদ্ধ শেষ হবে। মাগৌগের সেনাবাহিনী রাজা গৌগের নেতৃত্বে জেরুজালেমে ধ্বংসলীলা চালাবে। সেখানকার অর্ধেক অধিবাসীকেই জিম্মি করে ফেলবে। কিন্তু ইয়াহওয়েহ ইহুদিদের রক্ষা করবেন। তিনি গৌগ মাগৌগদের হত্যা করবেন।
উনিশ শতকের কিছু হাসিদিক (Hasidic) নেতা বিশ্বাস করতেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেপোলিয়ানের যুদ্ধ (১৮০৩-১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ) ছিল প্রকৃতপক্ষে গৌগ মাগৌগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
তথ্যসূত্র :
britannica.com
জুদাইজম- মাশরুর ইশরাক
আপনার মতামত জানানঃ