পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ বলে যে গর্ব ভারত করতো, তা আজ মোদির ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু সূচকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান নিচে নেমে গিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবেই। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতে বিপন্ন হয়েছে গণতন্ত্র। প্রতিবাদ করলেই সরকারের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিনা কারণে ইউএপিএ’র ধারা দিয়ে মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছ
সাংবাদিকদের উপর পুলিশের অত্যাচার, রাজনৈতিক নেতাদের চাপ সৃষ্টি, দুর্নীতিবাজ অফিসার ও অপরাধমূলক গোষ্ঠীর প্রতিশোধের হুমকি; সব মিলিয়ে ভারতের খর্ব হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। তবে ভারতের সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা ও মামলার ঘটনা অনেকটা নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতাসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে ফ্রান্সভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ জানিয়েছে, মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান নামতে নামতে এখন ১৫০-এ এসে ঠেকেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ৩০টি দেশের মধ্যে এখন ভারত একটি। অথচ এক বছর আগে ২০২১ সালে ভারত ছিল ১৪২তম দেশ।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ৮ ধাপ নামার পর ভারত এখন ‘সংবাদমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর দেশগুলোর একটি’। এ প্রতিবেদন গত মে মাসে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রতিবেদন প্রস্তুত পর্যন্ত ভারতে একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, জেলে রয়েছেন ১৩ জন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের এই প্রতিবেদনের আধারে লোকসভায় প্রশ্ন করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মালা রায়, ডিএমকে দলের এ রাজা ও এ গণেশমূর্তি। তাদের প্রশ্নের উত্তরে তথ্যমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর গত মঙ্গলবার লিখিতভাবে জানান, সরকার ওই সংগঠনের অভিমতের সঙ্গে একমত নয়। দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের অবস্থান নিয়ে সরকার আদৌ সহমত নয়। কেন নয় সেই ব্যাখ্যায় মন্ত্রী জানান, সমীক্ষার ‘স্যাম্পল সাইজ’ বা নমুনার পরিমাণ অত্যন্ত কম। তা ছাড়া গণতন্ত্রের আধার সম্পর্কে তাদের ধারণাও অত্যন্ত সীমিত। প্রায় নেই বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, যে পদ্ধতিতে দেশে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে মতামত জাহির করা হচ্ছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ।
অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, সাংবাদিকসহ দেশের সব নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষা করা সরকারের কর্তব্য। সরকার তা পালনও করে।
ভারতে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় ভারতে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত এসেছে।
সাংসদ মালা রায় অন্য এক প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলেন, দেশে মোট কতজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লিখিতভাবে জানিয়েছেন, এই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এখতিয়ারভুক্ত। অভিযুক্ত ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত, গ্রেপ্তার ও বিচার রাজ্য সরকারই করে থাকে। এই কাজ কেন্দ্রীয় সরকার করে না। তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’য় সাংবাদিক আটকের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
তথ্যমন্ত্রীর পেশ করা জবাব জানাচ্ছে, ২০২১-২২ সালে দেশে ৭৮টি ইউটিউব নিউজ চ্যানেল ও তাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, তারা ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৯(ক) ধারা লঙ্ঘন করেছে। ওই বছরে ৫৬০টি ইউটিউব ওয়েব লিংকও ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রতিবেদন অনুযায়ী সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্র হিসেবে ভারত খুবই ‘কঠিন’ দেশে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এক নম্বরে রয়েছে নরওয়ে। তারপর ডেনমার্ক, সুইডেন, এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ৪২তম। সবচেয়ে খারাপ দেশ উত্তর কোরিয়া (১৮০তম)। এর আগে রয়েছে ইরিত্রিয়া (১৭৯), ইরান (১৭৮), তুর্কমিনিস্তান (১৭৭), মিয়ানমার (১৭৬) ও চীন (১৭৫)।
ভারতে কয়েক বছর ধরেই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা–মামলার ঘটনা বাড়ছে, এমন অভিযোগ করে আসছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে, ভারতে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় ভারতে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত এসেছে।
দ্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের এক রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, হিন্দুবাদী সরকারের লাইনে থাকতে সংবাদমাধ্যমগুলির উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে৷ যে সব সাংবাদিকরা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বা কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লিখছেন বা মুখ খুলছেন, তাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে চরম হেনস্থা, হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ বিশেষ করে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন নারী সাংবাদিকরা৷
এদিকে, ফ্রিডম হাউস বলছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাগরিক স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে। তারা আরো বলেছে যে ‘মুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চ কাতার থেকে ভারতের এই পতন’ বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
মোদির শাসনকালে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ। কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের এই অবনতি হয়েছে। মোদির বিভিন্ন নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়েছে, এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দ্রুত কমছে। সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে সরকার ও কর্তৃপক্ষ ক্রমশ অগ্রাহ্য করছে। কেউ তাদের সমালোচনা করলেই হেনস্তা করা হচ্ছে। দেশদ্রোহের নামে সাংবাদিকদের জেলে পোরা হচ্ছে, অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য এটা বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২৬
আপনার মতামত জানানঃ