অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনির দাবির মুখে নতিস্বীকার করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আজ মঙ্গলবার তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা রেল ভবনের ফটকের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হলেও শেষ পর্যন্ত দাবির মুখে মহাপরিচালক (ডিজি) ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার নিচে নেমে আসেন। আন্দোলনকারীদের গোলাপ ফুল ও স্মারকলিপি গ্রহণ করে অব্যবস্থাপনা দূর করার আশ্বাস দেন।
ট্রেনের টিকিটে দুর্নীতি বন্ধ করাসহ ছয় দফা দাবিতে গত ৭ জুলাই থেকে কমলাপুর স্টেশনে একাই আন্দোলন করেছেন মহিউদ্দিন রনি। গতকাল তাকে স্টেশনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী কমলাপুর থেকে রেল ভবন অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন রনি। প্রথমে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যান। সেখানে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে তার সঙ্গে যোগ দিয়ে ২৫-৩০ শিক্ষার্থী সমাবেশ করেন।
শিক্ষার্থীরা হেঁটে ২টার দিকে রেল ভবনের সামনে যান। নিরাপত্তাকর্মীরা আগেই ফটক বন্ধ করে দেন। রনিসহ অন্য শিক্ষার্থীরা রেলের ডিজির কাছে স্মারকলিপি দিতে ভেতরে যেতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, প্রবেশের অনুমতি নেই। স্মারকলিপি ফটকে জমা দিলে মহাপরিচালককে পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে রনি ও শিক্ষার্থীরা এ প্রস্তাব নাকচ করে ডিজির সঙ্গে সাক্ষাতের দাবিতে অনড় থাকেন। দেড় ঘণ্টা বাগ্বিতণ্ডার পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মহাপরিচালক নিচে আসেন।
ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, লিখিত স্মারকলিপি পেয়েছেন। শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক। তা পূরণে কাজ করবে রেল। তবে মহিউদ্দিন রনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার দাবি পূরণের উদ্যোগ নেওয়া না হলে ফের আন্দোলনে নামবেন।
মহাপরিচালক তখন জানান, ট্রেন বা আসন বৃদ্ধির দাবি স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন অসম্ভব। ট্রেন বাড়াতে রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনে কাজ চলছে। টিকিট বিক্রিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে কাজ হচ্ছে। জবাবে মহিউদ্দিন রনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি পূরণের আশ্বাস চান।
বিকেল পৌনে ৫টা পর্যন্ত রেল ভবন চত্বরে অবস্থান করে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা। মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, ভয় দেখিয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করেছেন কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার। স্টেশন চত্বরেও প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না।
রনি গত জুন মাসে রেলের টিকিট কিনতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হন। এরপর ৭ জুলাই থেকে ছয়টি দাবিতে কমলাপুর রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে অবস্থান শুরু করেন। ঈদের দিনেও তিনি ছিলেন অবস্থান কর্মসূচিতে।
মহিউদ্দিন রনি বলেন, গত ১৩ জুন রেলওয়ের ওয়েবসাইট থেকে ঢাকা-রাজশাহী রুটের ট্রেনের আসন বুক করার চেষ্টা করলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা কাটা নিলেও তিনি ট্রেনের আসন পাননি। টাকা নেওয়ার বিষয়ে কোনো ডকুমেন্ট না দেওয়ায় তিনি সেদিন কমলাপুর স্টেশনের সার্ভার কক্ষে অভিযোগ জানালে সেখান থেকে ‘সিস্টেম ফেইল’ করার কথা বলা হয় এবং ১৫ দিনের মধ্যে টাকা না পেলে আবার যেতে বলা হয়। এভাবেই তার হয়রানির শুরু।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে দুইবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। কিন্তু সেখান থেকে তাকে শুনানির জন্য ডাকা হয়নি। তারপর তিনি অহিংস আন্দোলন শুরু করেন।
রনির দাবিগুলো হলো- অনলাইনে টিকিট কেনায় হয়রানি বন্ধ করে তদন্ত করতে হবে, হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে, অনলাইন-অফলাইনে টিকিট কেনার ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে, ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কসহ অন্য দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে, শক্তিশালী তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রেল সেবার মান বাড়াতে হবে এবং ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার, বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
অনিয়ম ও দুর্নীতির আঁতুড়ঘর
যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিদিন ৩৯৪টি ট্রেন পরিচালনা করে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রেলওয়ে। গত পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। ধারাবাহিক এ লোকসানের জন্য রেলের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করেছে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হলো রেলের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করা না হলে, রেলের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবং যাত্রীসেবার মান না বাড়ানো হলে লোকসান কমানো কষ্টকর হবে। সম্প্রতি রেল পরিষেবার মানোন্নয়ন ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রেলে অনিয়ম বেশি হয় এমন খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা। টিকিট কালোবাজারি কিংবা টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটছে। এসব কাজে রেলওয়েরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে টিকিট পরিদর্শকসহ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বিরুদ্ধে বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকা আদায়ের অভিযোগও পুরনো।
যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির একাধিক খাত চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। খাতগুলো হলো সম্পত্তি ইজারা ও হস্তান্তর, অবৈধ স্থাপনা তৈরি, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং ইত্যাদি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে ট্রেন পরিচালনার ব্যয় ও আয়ের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। পাশাপাশি বিদ্যমান সম্পদগুলো সুষ্ঠু ব্যবহার করে রেলকে সহজেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যেত। কিন্তু এসব শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাস্তবে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
ট্রেন পরিচালনায় মোটা দাগে ছয়টি খাতে টাকা খরচ হয় রেলওয়ের। এ খরচকে বলা হয় পরিচালন ব্যয়। খরচের খাতগুলো হলো প্রশাসনিক, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, স্টাফদের বেতন-ভাতা, জ্বালানি তেল ও স্টাফ বাদে অন্যান্য পরিচালন ব্যয় এবং বিবিধ খাত।
রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনগুলো পরিচালনা করতে ২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রেলওয়ে। বিপরীতে যাত্রীবাহী ট্রেনের টিকিট বিক্রি ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সংস্থাটি আয় করতে পেরেছে ১ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। তবে করোনা মহামারীর কারণে অর্থবছরের একটা বড় সময় দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এ কারণে লোকসান তুলনামূলক কম হয়েছে।
পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে ২০১৯-২০ অর্থবছর। লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর রেলওয়ে সব মিলিয়ে ৬৩৭ কোটি যাত্রী পরিবহন করে। একইভাবে ৩১ লাখ ৭৭ হাজার টন পণ্য পরিবহন করে। যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনায় খরচ হয় ৩ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। বিপরীতে সংস্থাটি আয় করে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। লোকসান কাটিয়ে লাভে ফিরতে বাংলাদেশ রেলওয়েকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো যাত্রীসেবা, অনবোর্ড সেবা, ক্যাটারিং সেবার মান বৃদ্ধিসহ যাত্রীদের টিকিটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, পণ্যবাহী ও কনটেইনার ট্রেন পরিচালনায় গুরুত্ব দেয়া, কমিউটার ট্রেনকে আরো জনবান্ধব করে তোলা এবং বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার করে সেগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার করা।
উন্নত প্রযুক্তি আর অবকাঠামো, দ্রুতগতির ট্রেন, কঠোর সময়ানুবর্তিতার মতো বিষয়গুলোয় জোর দিয়ে উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দিচ্ছে, সেখানে এখনো পুরনো অবকাঠামোগুলোই ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। সংস্কারের অভাবে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে রেলপথ। জনবলের অভাবে বন্ধ থাকছে স্টেশন। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন নতুন ট্রেন নামিয়ে বাড়ানো হচ্ছে শিডিউল বিপর্যয়। রেলপথ, রোলিংস্টক, সিগন্যাল ব্যবস্থা, জনবল, ট্রেন পরিচালন ব্যবস্থা, যাত্রীসেবায় বছরের পর বছর ধরে কেবল লোকসানই গুনে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ