২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১ লাখ ৭ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। ২০০৯ সাল থেকে পরিচালন ব্যয়সহ রেলের জন্য খরচ করা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময়ে ৯৩টি প্রকল্প গ্রহণ ও ৮৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলেও গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রেই সমস্যার পাহাড় নিয়ে চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় শুধু নেই আর নেই। এ পরিস্থিতিতে দিন দিন রেলের সেবার মান কমছে। সব মিলিয়ে রেল পরিচালনায় অত্যাবশ্যকীয় ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রেল খাতে সবচেয়ে প্রবল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—জনবল, ইঞ্জিন, বগি, প্রয়োজনীয় ট্রেন, সিগন্যাল, স্টেশন, বন্ধ ট্রেন, বন্ধ স্টেশন, পুরোনো লাইন, সিঙ্গেল লাইন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু।
তবে এ সংকটের জন্য ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলকে দায়ী করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, সবকিছু সমাধানের চেষ্টা চলছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এজন্য মাস্টারপ্ল্যান করার কথাও জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএনপি সরকারের আমলের ওপর দায় দিয়ে সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ১৫ বছরে রেল কর্তৃপক্ষ বড় বড় প্রকল্পের দিকে নজর দেওয়ায় চলমান সংকটগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে অনেকটা পরিকল্পিতভাবে বা দায়িত্ব এড়িয়ে রেলকে পথে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলে এখন সবচেয়ে বড় সংকট জনবল। বর্তমানে অনুমোদিত ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনবলের বিপরীতে আছে প্রায় ২৫ হাজার। প্রায় ২২ হাজার পদ শূন্য। এর মধ্যে চালক সংকট চরমে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত চালকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে জোড়াতালির ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম নিজেই বলেছেন, দক্ষ জনবলের অভাবে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। অবসরপ্রাপ্ত চালকদের নিয়োগ দিয়ে রেল পরিচালনা করা হচ্ছে। এর বাইরে রেলের প্রায় ৭০ ভাগ ইঞ্জিনের মেয়াদ নেই। ইঞ্জিন সংকটে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে ট্রেন চলাচল। ৮০ ভাগের বেশি অ্যানালগ সিগন্যাল। অথচ সিগন্যাল ত্রুটির কারণে ঘটছে বেশিরভাগ ট্রেন দুর্ঘটনা। যাত্রী ও পণ্যবাহী বগি সংকটও চরমে। বন্ধ আছে শতাধিক ট্রেন। সারা দেশে ৪৮৪টির মধ্যে এক যুগের বেশি সময় ১১৬টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, দেশে মোট যাত্রীর ৮ শতাংশ রেলের। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। একই সঙ্গে মোট পণ্য পরিবহনে রেলের অবদান ২৮ থেকে নেমে এসেছে ১৬ শতাংশে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয় ছিল ৫৬১ কোটি টাকা। যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন করে এ আয় করেছে রেল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচালন ব্যয়ও বেড়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করে তৈরি করা রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা তুলনামূলক কম।
জানা গেছে, করোনার সময় বন্ধ হওয়া ১০৫ ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেই। মূলত ইঞ্জিন ও বগি সংকটের কারণে এসব ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না। যাত্রীবাহী বগির ৪৭ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। রেলের হিসাবে, যাত্রীবাহী বগি আছে ১ হাজার ৯৮০টি। এর মধ্যে চলাচলের উপযোগী ১ হাজার ৫৯৮টি। বাকি কিছু মেরামতে ছিল, অন্যগুলো বিকল।
সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন ৩২০টি। আদতে তা চলে ৭৪টি রেকে (ট্রেনের বগির সমন্বয়), অর্থাৎ এক রেকে একাধিক নামে ট্রেন চালানো হয়। তবে রেলসেবা বিস্তৃত করতে কত বগি প্রয়োজন, সে হিসাবও তৈরি করেছে সংস্থাটি। সে অনুযায়ী, আন্তঃনগর ট্রেনকে লাভজনক করতে প্রতি ট্রেনের লোড ২০ থেকে ৪০, অর্থাৎ যাত্রীবাহী ২০টি বগি থাকা প্রয়োজন। আন্তঃনগরে প্রয়োজন ৯৯৭টি বগি। লোকাল, মেইল, কমিউটারসহ প্রয়োজন ২ হাজার ২৭১টি বগি। ১৫ বছরে ১০৯টি ইঞ্জিন কেনা হলেও রেলের হিসাবে ১৮০টি ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। অর্থাৎ প্রায় ৭০ ভাগ ইঞ্জিন মেয়াদ ছাড়া চলছে। ঠিকাদারের অর্থায়নে ২০১১ সালে ৭০টি ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প ছিল রেলের। ২০২৩ সালে তা বাতিল হয়।
দেশের ৪৩টি জেলার ওপর দিয়ে রেলের ৩ হাজার ১৫৭টি লেভেল ক্রসিং গেট রয়েছে। যার মধ্যে ১ হাজার ৪৭৭টি ক্রসিং অবৈধ। আবার বৈধ ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৪৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ গেটে গেটম্যান রয়েছে। ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ গেট উন্মুক্ত, অর্থাৎ গেটম্যান নেই।
এমন অবস্থায় এলজিইডির আওতায় পল্লি সড়ক নেটওয়ার্কে অবস্থিত অবৈধ, অরক্ষিত ও চরম বিপজ্জনক রেলক্রসিংগুলোর অপসারণ বা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুটি সংস্থার মধ্যে ‘দ্বন্দ্ব’ চলমান। অবৈধ ক্রসিং এবং নিরাপত্তাহীন গেটের কারণে ট্রেনের গতি দিন দিন কমছে। জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলের ৮০ শতাংশের বেশি অ্যানালগ সিগন্যাল ব্যবস্থায় চলছে নিরাপদ যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পরিচিত রেলপথ। যখন গোটা বিশ্ব আধুনিক সিগন্যাল পদ্ধতিতে রেল পরিচালনা করছে তখন সনাতনী পদ্ধতির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে রেলব্যবস্থা।
রেল সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে এখন রেলপথ আছে ৩ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে ৪ হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। রেল মন্ত্রণালয়ের ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। সে হিসাবে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি রেলপথ পুরোনো। পুরোনো রেলপথের বড় অংশের লাইন ব্রিটিশ আমলে তৈরি। রেলের হিসাবে পুরোনো ৭০ ভাগ লাইনের মেয়াদ ফুরিয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক বলেন, একটি রেললাইনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। অনেক রেললাইনের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। পুরোনো লাইনের কারণে রোদে লাইন বাঁকা হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
রেলপথে ছোট-বড় কালভার্ট-ব্রিজ রয়েছে ৩ হাজার ১৪৩টি। এর মধ্যে স্বাধীনতা-পূর্বকালে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তৈরি ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ রেল কর্তৃপক্ষের বছরভিত্তিক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪০০ ব্রিজ-কালভার্ট চলাচলের অনুপযোগী বা ঝুঁকিপূর্ণ। সংস্কার না হওয়ায় রেল চলাচলে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে। জানা গেছে, রেলের ৪০২টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর সেতুগুলোর সংস্কার না করার কারণে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রেলপথে ৩২৬ বড় সেতু (৬০ ফুট বা তার বেশি) এবং ছোট সেতু রয়েছে ২ হাজার ৮১৭।
রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেনচালকদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দিয়ে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন পরিচালনার কথা থাকলেও শুধু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ট্রেনচালকরা ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতিতে এসব সেতু পার করেন। রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, এরই মধ্য কিছু নতুন সেতু নির্মাণ ও কিছু পুরোনো সেতু সংস্কার হয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৩ সালে প্রথম বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ‘রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যান’ অনুমোদন করে সরকার। এ মহাপরিকল্পনায় ২০ বছর মেয়াদে (জুলাই ২০১০ থেকে জুন ২০৩০ মেয়াদে) চারটি পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩৫টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রেলওয়ের জন্য জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০৪৫ পর্যন্ত ৩০ বছর মেয়াদের হালনাগাদকৃত মহাপরিকল্পনা অনুমোদন হয়েছে। নতুন অনুমোদিত মহাপরিকল্পনায় ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্ত আছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে রেলওয়ের সেবা ও গুণগতমান বহুগুণ বৃদ্ধি করে রেলপথকে আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
নানামুখী সংকটের মুখে রেল পরিচালনায় অনেক চ্যালেঞ্জ দেখছে রেল কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ব্রিটিশ-ভারত রেলওয়ের অংশ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বর্তমানে পরিবর্তিত ট্রাফিক প্রবাহ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না। তাই রাজধানীমুখী রেলওয়ে নেটওয়ার্ক পরিবর্তন, চট্টগ্রাম বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব কমানো এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্কের বহির্ভূত জেলাগুলোকে রেলওয়ের নেটওয়ার্কভুক্ত করা সময়ের দাবি।
কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যমান সিঙ্গেল রেললাইন সুষ্ঠু ট্রেন পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, যা দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। ভারতীয় রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের নয়টি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টের মধ্যে ছয়টি চালু রয়েছে। বন্ধ ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্টগুলো পুনরুজ্জীবিত করা ও নতুন একটি ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট চালু করার জন্য প্রকল্প চলমান রয়েছে।
রেলের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৬০ ভাগ লোকোমোটিভ, ৪৭ ভাগ যাত্রীবাহী কোচ এবং ৬৭ ভাগ ওয়াগনের অর্থনৈতিক জীবনকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, যা ট্রেনের সময়ানুবর্তিতাকে বিঘ্নিত করছে। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে নতুন রোলিং স্টক সংগ্রহ (ক্রয়) করা প্রয়োজন।
রেলওয়ে বর্তমানে অপারেশনাল জনবল যেমন—স্টেশনমাস্টার, লোকোমাস্টার (চালক), পোর্টার, লেভেল ক্রসিং গেটম্যানের সংকটে রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে রেলওয়েতে ১৩ হাজার ৯৮১ জনবল নিয়োগ করা হলেও দক্ষতার সঙ্গে দৈনন্দিন অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক জনবল নিয়োগ প্রয়োজন। রেলওয়েতে আধুনিক ওয়ার্কশপ ও কারখানা স্বল্পতার কথা স্বীকার করে বলা হয়, রোলিং স্টকগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ওয়ার্কশপগুলোর আধুনিকায়ন প্রয়োজন।
এ সম্পর্কে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, ‘রেল পরিচালনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংকট আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা ধীরে ধীরে সবকিছু সমাধানের চেষ্টা করছি।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় রেল পরিচালনায় মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। কেন সবাই অর্থের পেছনে লাগামহীন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। এতে প্রমাণিত হয়, পরিকল্পিতভাবেই রেলকে দুর্বল ও অসহায় করে রাখা হয়েছে।’
আপনার মতামত জানানঃ