২০১৫ সালের পহেলা এপ্রিল ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর সেই দেশ থেকে বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
নিষেধাজ্ঞার বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি গবাদি পশু আসতো, যার মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এত বড় মার্কেটে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞায় নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরাও৷ এর আগেই মাংসের বাজারে আগুন লেগেছিল।
এরপর বাংলাদেশে গবাদি পশু, বিশেষ করে গরুর মাংসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা জেগেছিল। তবে সে আশঙ্কা সত্যি হওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ মাংসের গরু উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে গেছে বলে দাবি করছে সরকার এবং খামারিরা।
সরকারিভাবে গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হলেও থেমে নেই বিদেশি মাংস আমদানি। বাংলাদেশ ১৪টি দেশ থেকে মাংস আমদানি করে, যার সবচেয়ে বড় উৎস ভারত।
তবে দেশের স্থানীয় গবাদি পশু খামারিদের উৎসাহিত করতে ও গবাদি পশুর চাষিদের রক্ষায় ভারত থেকে হিমায়িত মাংস বিশেষত মহিষের মাংস আমদানি বন্ধ করে সরকার।
২০২২ সালে জারি করা নির্দেশনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, হিমায়িত মহিষের মাংস আমদানির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি লাগবে।
এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ জানিয়েছে ভারতীয় রপ্তানিকারক ও বাংলাদেশি আমদানিকারক সমিতি।
সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন প্রস্তাব দেয় যে, বাংলাদেশে ফের মাংস রপ্তানি করতে চায় ভারত।
এক বিবৃতিতে তারা জানায়, নীতির পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক মাসে কোনো হিমায়িত গরুর মাংস আমদানি না হওয়ায় তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এক চিঠিতে অল ইন্ডিয়ান বাফেলো অ্যান্ড শিপ মিট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (এআইএমএলইএ) ও বাংলাদেশ মিট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমআইটিএ) সরকারকে বিষয়টি সমাধানে কিছু ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানায়।
চিঠিতে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মাংস আমদানিতে ২০% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ভারত থেকে হিমায়িত হাড়বিহীন গরুর মাংস আমদানির জন্য ৪-৫ কেজি থেকেই এই কর বসানো হবে।
এটি ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য সাফটা চুক্তির সুবিধাকে লঙ্ঘন করে।
এতে বলা হয়, ভারতীয় কোম্পানিগুলো উচ্চ-মানের ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রক্রিয়াজাত মাংসের বৃহত্তম রপ্তানিকারক এবং সেটি বাংলাদেশে অ-প্রতিযোগিতামূলক।
জানা গেছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামে সম্প্রতি গরু জবাই, মাংস খাওয়া ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণে একটি বিল পাস করেছে রাজ্য সরকার।
পাস করা এই বিলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাছুর থেকে শুরু করে ১৪ বছরের কম বয়সী গরু জবাই। বিলটিতে পুরুষ ও স্ত্রী ষাঁড় ও মহিষ, গরু, গাভী, বাছুর, বকনা বাছুর ইত্যাদিকে গরু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
ভারতে মোট ১২ টি রাজ্য রয়েছে, যেখানে গরু জবাইয়ের উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ১০ টি এমন রাজ্য রয়েছে যেখানে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা নেই। একইসাথে, এমন ৭ টি রাজ্য রয়েছে যেখানে গরু জবাইয়ের উপরে আংশিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা বলেন, ‘গত পাঁচ বছর বা তার আগেও রাজ্যে যত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, সবগুলোরই কারণ ছিল গোমাংস। নতুন বিলের ফলে গোমাংস না খাওয়া ব্যক্তিদের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ব্যক্তি গোমাংস না খেলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বেরও কোনো সুযোগ নেই।’
২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করে দেয়৷ আর সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ৷ এখন বাংলাদেশ গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
একসময় গরুর মাংস রপ্তানিতে শীর্ষ ছিল ভারত। ২০১৭ থেকে নিচে নামতে থাকে ভারতের রপ্তানির সূচক। তবু ২০১৯ সালে গরুর মাংস রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ ছিল এই ভারত। তাই গরু জবাই ও মাংস খাওয়ার ওপর ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা যে পুরোটাই দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের এক হাতিয়ার, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গরু রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মাংস রপ্তানিতে এত আগ্রহ কেন ভারত? গরু রপ্তানিতে তাদের সমস্যা কোথায়? সমস্যা যেখানেই থাকুক, গরু আটকে মাংস রপ্তানিতে ভারতের যেই সুবিধাই থাকুক না কেন, ভারতীয় রপ্তানিকারক ও বাংলাদেশি আমদানিকারক সমিতির ব্যবসা চাঙ্গা করার জন্য যতই কর ছাড়ের প্রলোভন দেওয়া হোক না কেন, বাংলাদেশকে নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতার কথা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে দেশের খামারি ও চাষিদের কথা। বাংলাদেশ যে এক্ষেত্রেও উত্তরণ ও উন্নয়নে এগিয়ে যাবে সেবিষয়ে সন্দেহ নেই।
২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করে দেয়৷ আর সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ৷ এখন বাংলাদেশ গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
দেশের স্থানীয় গবাদি পশু খামারিদের উৎসাহিত করতে ও গবাদি পশুর চাষিদের রক্ষায় ভারত থেকে হিমায়িত মাংস বিশেষত মহিষের মাংস আমদানি বন্ধ করে সরকার যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ এখন মাংস উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে ৭.৪ মিলিয়ন টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে ৮.৪৪ মিলিয়ন টন মাংস উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশের উচিত হবে এখন মাংস রপ্তানিতে এগিয়ে যাওয়া।
স্বাধীনতার পর থেকে চলমান ৫০ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রায় সফলতা ও ব্যর্থতা দুই-ই আছে বাংলাদেশের। তবে সফলতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, রপ্তানি খাতের ওপর ভর করে বাংলাদেশ স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বহুকাল আগে থেকে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করে। সামনে বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে বড় তিনটি লক্ষ্যমাত্রা। এর মধ্যে ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদালাভ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে উপনীত হওয়া এখন বাংলাদেশের অন্যতম রূপকল্প।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলার পথটা অতটা সুগম হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ বরাবরই নিজের জায়গা থেকে সংকট উত্তরণে দৃষ্টান্ত তৈরি করে আসছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশে মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, আয়বৈষম্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। তবে এসব সমস্যা প্রশমন করেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট রসদ রয়েছে বাংলাদেশের।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৬৫৮
আপনার মতামত জানানঃ