মা-বাবাসহ রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হওয়ার সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ধাওয়ায় নদীতে পড়ে নিখোঁজ হয় দুই শিশু। বাবা-মা নদী সাঁতরে পাড়ে উঠে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করলেও হাত ফসকে শিশুদুটি নদীতে ডুবে যাওয়ায় আর সন্ধান মেলেনি। তিনদিন পর (০৩ জুলাই) রবিবার সকাল ৮টার দিকে ঐ সীমান্ত এলাকায় লীলকোমল (ভারতের অভ্যন্তরে) নদীতে ডুবে যাওয়া শিশু দুটির লাশ ভেসে ওঠে।
নদী থেকে ভাই-বোনের লাশ উদ্ধার করে বিএসএফ ও ভারতীয় পুলিশ। পরে ভারতীয় সাহেবগঞ্জ থানা পুলিশের মাধ্যমে দুই শিশুর মরদেহ স্থানীয় মর্গে পাঠানো হয়। এ সময় বাংলাদেশ সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্ধার দুই শিশুর নাম পারভীন খাতুন (৮) ও শাকিবুল হাসান (৪)। তারা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নেওয়াশী ইউনিয়নের সরকারটারি গ্রামের রইচ উদ্দিন-সামিনা বেগম দম্পতির সন্তান।
বিজিবি জানিয়েছে, মৃত শিশু দুই ভাই-বোনের লাশ এক সপ্তাহ মর্গে রাখতে পারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তবে মৃত শিশুদের কাগজপত্র ও ছবি বিএসএফের কাছে দেওয়া হলে ফেরত নিয়ে আসার জন্য পরবর্তী আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করা হবে।
শুক্রবার ভারতের দিল্লি থেকে পারভীন খাতুন (৮) ও সাকেবুল হাসান (৪) তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কুরবানি ঈদ পালন করার জন্য অবৈধপথে বাংলাদেশে ফিরছিল। এ সময় ভারতীয় দালালরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের সীমান্তে নিয়ে এসে এক বাড়িতে রাখে। ওই দিন মধ্যরাতে আন্তর্জাতিক ৯৪৩নং মেইন পিলারের কাছ দিয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার ধর্মপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে দুই দেশের দালাল চক্র।
দালাল চক্র মা-বাবাসহ শিশুদের কাঁটাতার কেটে নীলকমল নদের তীরে নিয়ে আসে। এ সময় ডিউটিরত ভারতের শেউটি-১ ক্যাম্পের বিএসএফের সদস্যরা টর্চলাইট জ্বালিয়ে দেখার পর ধাওয়া করে। দালালরা তড়িঘড়ি করে নদ পার হওয়ার জন্য তাদের চাপপ্রয়োগ করে।
এ সময় মৃতের বাবা রহিচ উদ্দিন মালপত্র নিয়ে নদীর মধ্যখানে চলে যান। তখন দুই ভাইবোন মা ছামিনার কাছে থাকে। কিন্তু তারা কেউই সাঁতার না জানার কারণে স্রোতের টানে রাতের অন্ধকারে মায়ের হাত থেকে ছুটে গিয়ে নিখোঁজ হয় শিশু পারভিন ও সাকেবুল।
বিএসএফের ধাওয়ায় নদে ডুবে যাওয়া ভাই-বোনের লাশ রোববার সকাল বেলা নিখোঁজ স্থানের নদের পানিতে ভেসে উঠে। দুইশ গজ অদূরে তাদের লাশ স্থানীয়রা দেখে খবর দেয় বিজিবিকে। নদটি ভারতের ভূখণ্ডে হওয়ায় বিজিবি বিএসএফকে অবগত করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বাবা-মা নদী সাঁতরে পাড়ে উঠে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করলেও হাত ফসকে শিশুদুটি নদীতে ডুবে যাওয়ায় আর সন্ধান মেলেনি। তিনদিন পর (০৩ জুলাই) রবিবার সকাল ৮টার দিকে ঐ সীমান্ত এলাকায় লীলকোমল (ভারতের অভ্যন্তরে) নদীতে ডুবে যাওয়া শিশু দুটির লাশ ভেসে ওঠে।
বৈঠক শেষে বিজিবি-বিএসএফের কড়া পাহারায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা থানা পুলিশ ও বিএসএফ ভাই-বোনের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
এদিকে দুই সন্তানের মৃত্যুতে রইচ উদ্দিন ও সামিনার পরিবার শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে।
সন্তানদের মরদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে রইচ বলেন, আমরা বাংলাদেশি হলেও শিশুদের জন্ম হয়েছে ভারতে। এ কারণে তাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্বের কাগজপত্র নেই। ফলে দুই সন্তানের মরদেহ ফিরিয়ে আনতে তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
লালমনিরহাট বিজিবি ১৫ ব্যাটালিয়নের কাশিপুর কোম্পানি কমান্ডার কবির হোসেন বলেন, দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধারের পর বিএসএফ ভারতীয় পুলিশের মাধ্যমে তা ওই দেশের স্থানীয় মর্গে পাঠিয়েছে।
পতাকা বৈঠকের বরাতে বিজিবির এই সদস্য জানান, বিএসএফ জানিয়েছে শিশুদের মরদেহ এক সপ্তাহ মর্গে থাকবে। তাদের বাংলাদেশি পরিচয়ের কাগজপত্র পাওয়া গেলে মরদেহ হস্তান্তরের বিষয়টি তারা বিবেচনা করবে।
নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৪
আপনার মতামত জানানঃ