চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি জুন) সীতাকুণ্ডসহ দেশের ২৪১টি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৩৩৩ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। গত বছরের একই সময় ২২০টি কর্মক্ষেত্র দুর্ঘটনায় ৩০৬ জন নিহত হয়েছিলেন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু উভয়ই বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
মোট ২৬টি দৈনিক সংবাদপত্র (১৫টি জাতীয় ও ১১টি স্থানীয়) পর্যবেক্ষণ করে জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
যেসব শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের বাইরে, কর্মক্ষেত্র থেকে আসা যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় ও অন্য কোনো কারণে মারা গিয়েছেন তাদের এ জরিপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ বছরের প্রথম ছয় মাসে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৩০৬ জন শ্রমিক নিহত হন। ওই সময় কর্মক্ষেত্রে ২২০টি দুর্ঘটনা ঘটে।
জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ছয় মাসে সর্বাধিক ১৩৮ শ্রমিক নিহত হয়েছেন পরিবহন খাতে। ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সেবা প্রতিষ্ঠানে ১০০ শ্রমিক। বিএম কনটেইনার ডিপোর নিহতরা এ খাতের অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু নির্মাণ খাতে; ৪৮ জন, কল-কারখানা ও অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে ২৬ জন এবং কৃষি খাতে ২১ জন শ্রমিক মারা যান।
কর্মক্ষেত্রে এতগুলো মৃত্যুর জন্য মূলত কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে সেইফটি অ্যান্ড রাইটসের পক্ষ থেকে।
নির্মাণসহ সব ধরনের কর্মক্ষেত্রেই শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রশ্নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই প্রধানত দায়ী। আবার দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালিক কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে এ রকম নজিরও খুব বেশি নেই।
সংস্থাটির আইন কর্মকর্তা হাছিনা খানম বলেন, শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ গুরুত্ব দিলে অনেক দুর্ঘটনা এবং এত মৃত্যু এড়ানো সম্ভব ছিল। নির্মাণসহ সব ধরনের কর্মক্ষেত্রেই শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রশ্নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই প্রধানত দায়ী। আবার দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালিক কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে এ রকম নজিরও খুব বেশি নেই। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও চলে টালবাহানা।
মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫৩ জন, আগুনে পুড়ে ৫৭ জন, বিদ্যুস্পৃস্ট হয়ে ২৫ জন শ্রমিক মারা গেছেন। বাকিরা বয়লার বিস্ফোরণসহ অন্যান্য কারণে।
জরিপের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগে বাধা, বেপরোয়া যান চলাচল ও অদক্ষ চালক পরিবহন দুর্ঘটনার মূল কারণ।
এছাড়া আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে এসআরএস জানিয়েছে, কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, কেমিকেল সংরক্ষণে অদক্ষতা ও অবহেলা, কারখানায় জরুরি বহির্গমন পথ না থাকা, কারখানা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি না নেওয়া, সেফটি বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া।
বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়ে বৈদ্যুতিক লাইনে সংযোগ দেওয়া, ভেজা হাতে মটর চালু করা, মাথার ওপরে যাওয়া বিদ্যুতের লাইনের নিচে কাজ করা, ভবনের পাশে দিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক তারে লোহার রড উঠানো।
এসআরএস’র নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, পরিবহনখাত নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে। অন্যথায় বাড়তেই থাকবে দুর্ঘটনা।
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে মালিকদের অবহেলা এবং সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যথাযথ পরিদর্শনের ঘাটতি এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে জানান তিনি।
অনেক দুর্ঘটনা, মৃত্যু- তারপরও নিরাপদ হয়নি কর্মক্ষেত্র। বকেয়া বেতন কিংবা শ্রম-অধিকার প্রশ্নে এখনও বঞ্চিত শ্রমিক। নিশ্চিত হচ্ছে না ন্যূনতম জীবনমান। কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত নির্মাণশিল্প। গত ১০ বছরে এই খাতে নিহত হয়েছে ১ হাজার ১০২ জন শ্রমিক।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ (বিলস) পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ২০২১ সালে ১ হাজার ৫৩ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বলেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে পরিবহন, নির্মাণ ও কৃষি এই তিন খাতে।
প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। রাজধানীসহ দেশজুড়ে গড়ে উঠছে বিপুলসংখ্যক বহুতল ভবন। এসব ভবন নির্মাণে শ্রমিকদের দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কোনো ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না।
বহুতল ভবনে নির্মাণ শ্রমিকরা অরক্ষিত অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি এসব দুর্ঘটনা থেকে পথচারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচের পথচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। কেউ কেউ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।
মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব এবং শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এ নির্মাণ সেক্টরে ৩৭ লক্ষাধিক পেশাজীবী জড়িত। শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘শিল্প স্বাস্থ্য সেফটি কমিটি’ গঠন করতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি কমিটি থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এই কমিটি নেই। ফলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা মালিক পক্ষকে চাপ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তারা বলেন, নির্মাণ খাতের বড় বড় ফার্ম কিছুটা নীতিমালা মেনে চলে। কিন্তু ছোট কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনগুলো এই নীতিমালা মানতে চায় না। এ জন্য ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। পরিদর্শনের জন্য তাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করবে। না হলে এসব ঘটনা এড়ানো যাবে না।
এসডব্লিউ/ এমএন/কেএইচ/১৯২১
আপনার মতামত জানানঃ