গত ১০ বছরের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় শীর্ষ অবস্থানটি ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাথে বিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংঘাত সংঘর্ষ হচ্ছে দলটির অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে।
শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের সাথে তাদের জোট এবং মহাজোটের নেতা কর্মীদের সঙ্গেও সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশি সংঘর্ষ হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। তবে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘাতের ঘটনা বেশি। আর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন নিজেদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে গেলে না থাকায় আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। তাই তাদের নিজেদের মধ্যেই সংঘাত বেশি। আগামী নির্বাচন কতটা অবাধ হবে তার ওপর নির্ভর করছে আগামীর সহিংসতার ধরণ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ২০১টি। এইসব ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই হাজার ২৬২ জন। নিহত হয়েছেন ৪১ জন।
এটা ২০২০ সালে এক বছরে নিহতের চেয়ে বেশি। ওই বছর নিহত হয়েছিলেন ৩১ জন। ২০২১ সাল থেকে নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২১ সালে রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিহত হন ১৫৭ জন। এর কারণ হিসবে ২০২১ সালের পুরো বছরই স্থানীয় সরকারের নানা পর্যায়ের নির্বাচনকে দায়ী করা হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আর দেড় বছর পর জাতীয় নির্বাচন, তাই ক্রমেই রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ার আশঙ্কা আছে।
আসকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে যে ২০১টি সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে সাতটি, ছাত্রলীগের সাথে বিএনপির তিনটি, জাসদের সাথে চারটি, ছাত্র অধিকার পরিষদের সাথে তিনটি, মোট ১৮টি। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে মোট ২৫টি। শুধু আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ২০টি।
রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও কম নয়। মোট ১৯টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের সাথে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে বিএনপির, ১২টি।
এই সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মোট ১২৮টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৪০ জন নিহত এবং এক হাজার ২৪১ জন আহত হয়েছেন। একজন নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের মোট সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৯৬ টি। গত বছর শুধু আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের সংঘাতে ৯ জন নিহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ বিএনপির সংঘাতে আট জন। এই সময়ে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘাতের ঘটনা বেশি ১৭টি। আহত হয়েছেন ৬৩২ জন।
ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ৭৪৯টি সংঘাতের ঘটনায় ১২৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাত হাজার ৮২৭ জন।
এর আগের বছর ২০২০ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা তুলনামূলকভাবে কম ছিলো। তারপরও আওয়ামী লীগই শীর্ষে ছিলো। তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত হয়েছে ৭৪টি। আর বিএনপির সাথে সংঘর্ষ হয়েছে সাতটি।
এদিকে, মানবাধিকার কর্মী ও আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন, “আওয়ামী লীগ যেহেতু এখন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী তাই এখন তাদের নিজেদের মধ্যেই সংঘাত হচ্ছে। এটা ক্ষমতার মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই। আর বিএনপির সাথে পুলিশের সংঘাত বেশি হওয়ার কারণ বিরোধীদের প্রতি দমন নীতি।”
তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচনও যদি ২০১৮ বা ২০১৪ সালের মত হয় তাহলে সংঘাত আরো বাড়বে। আর সেই সংঘাত হবে আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের।”
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তো বিএনপি ছিলোনা। তারপরও এত সংঘাত কেন? এর কারণ হলো নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই।”
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, “আগামী নির্বাচন যদি অংশগ্রণমূলক হয় তাহলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাত কমবে। এখন এটা বেশি হচ্ছে কারণ মাঠে প্রতিপক্ষ নেই। তাই তাদের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থের লড়াই চলছে। বাংলাদেশে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে প্রবণতা অনেক আগে থেকেই। সেটা এখনো চলছে। তাই পুলিশ বিএনপি বা বিরোধীদের সাথে সংঘাতে জড়াচ্ছে।”
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যত সচল হলে এই ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত তত কমবে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০৩
আপনার মতামত জানানঃ