করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমেছে। তবে এর প্রভাব এখনো চলছে। অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মন্দা কাটিয়ে উঠতে আরো সময় লাগবে বলেই উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের অভিমত। সেই অভিমতের সঙ্গে একমত পোষণ করে সরকার এখনো উদ্যোক্তাদের নানামুখী সুবিধা দিচ্ছে। যদিও সেই সব সুবিধা পেয়েছে হাতে গোনা কয়েক জন বা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী। সরকারের দেওয়া সুবিধার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত মার্চ মাস শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি-মার্চ এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তিন মাস আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে শুরু হয় মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। এই সংকটকালে ঋণখেলাপিদের আরো সুবিধা দেয় সরকার। ফলে কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়নি কাউকে। এতে ঋণের শ্রেণিমানও পরিবর্তন করা হয়নি। কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ঋণের কিস্তি বা খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেছে। এর মানে হচ্ছে, এই এক বছর কেউ কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি; যে ঋণ যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই রাখা হয়েছিল। এই সময়ে যে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে, সেটা কিছু উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগেই দিয়েছেন। পরে ২০২১ সালে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। ঐ বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের সামান্য অংশ পরিশোধ করলেই আর খেলাপি করা হয়নি। এই ছাড়ের কারণে একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তা তিনি করেননি। ফলে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
২০২১ সালে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কেউ এ হারে টাকা দিলেও ব্যাক ডেটেও নিয়মিত থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও কেউ খেলাপি হয়নি। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রথমে এ সুবিধা দেওয়া হয়। পরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে আবার সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর করা হয়। এরপর ২০২১ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধা আর বাড়বে না।
এই এক বছর কেউ কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি; যে ঋণ যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই রাখা হয়েছিল।
তবে ২৭ আগস্ট শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার দিয়ে জানায়, একজন ঋণ গ্রহীতার যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা ডিসেম্বরের মধ্যে কেউ ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলে তিনি আর খেলাপি হবেন না। পরবর্তীতে ৩০ডিসেম্বর এই নির্দেশনায় পরিবর্তন এনে বলা হয় ১৫ শতাংশ দিলেও তাকে খেলাপি করা যাবে না।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার যে সুবিধা দিয়েছে, তা গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী করে তুলেছে। এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে আরও ভয়াবহ হবে।
যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নে সমাজ-ধনবিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গগুলোর প্রয়োগ প্রক্রিয়ার উৎকর্ষকতা কল্যাণমুখী মানবিক সমাজ বিনির্মাণে প্রণিধানযোগ্য অবদান রেখে আসছে। অনগ্রসর থেকে প্রাগ্রসর সমাজে পরিণত হওয়ার পটভূমিতে রয়েছে শিল্প-নগরায়নের শক্তিমান গতিশীলতার ব্যাপক প্রভাব। ক্ষুদ্রায়তনের জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিগত কয়েক দশক শ্রমঘন শিল্পের প্রসার এবং গুণগত মানসম্মত উৎপাদিত পণ্যের বিতরণ-বাণিজ্যিকীকরণ দেশের রাজস্ব খাতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ পরিতোষ সৃজনে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এরই আলোকে দেশে শিল্পঋণ বিতরণ-ব্যবহার-অতিরঞ্জিত প্রতারণা-চিহ্নিত মাফিয়া চক্রের সিন্ডিকেট কর্তৃক ঋণগ্রহণে যথেচ্ছাচার-অপকৌশলে বিদেশে অর্থ পাচার দেশকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।
করোনার কারণে গত দুই বছর ঋণ পরিশোধে ঢালাও সুবিধা পেয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধাও। তারপরও শিল্প খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমাতে হলে সুশাসন বাড়িয়ে দুর্নীতি বন্ধ করে প্রতিটি ঋণ যথাযথভাবে যাচাই-বাছাইয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণের মান বাড়াতে হবে। ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের শাস্তির দৃশ্যমানতা এবং স্বচ্ছতাই ঋণখেলাপি হ্রাসের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে বলে তাদের মতামতে উঠে আসে।
তারা বলেন, ঢালাওভাবে সুবিধা দেবে; আদায়ে কোনো চাপ দেবে না তাহলে তো খেলাপি ঋণ বাড়বেই। কারণ খেলাপিরা দেখছে ঋণ পরিশোধ না করলেও কিছু হয় না। তাই তারা ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উন্নতি করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে টার্গেট দিয়ে দিতে হবে। যারা টার্গেট অনুযায়ী আদায় করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ