সেক্সের প্রসঙ্গ মানুষ এড়িয়ে যান৷ যত তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন, এড়িয়ে যেতে থাকেন, ততই বাচ্চাদের কাছে তা নিষিদ্ধ ফলের মতো হাতছানি দেয়৷ অথচ, বিষয়টি একেবারে স্বাভাবিক৷ সেই স্বাভাবিক বিষয়টি এভাবে অস্বাভাবিক করার জন্য ছেলে-মেয়েদের সামনে সবসময় হাতছানি থাকে৷ তারা ভুলের ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে থাকে অনেকসময়৷ আর এর সবথেকে বড় ভুক্তভোগী নারীরা।
সভ্যতার শুরুতে নারীরা ঘরে নির্যাতিত হতেন। আর এখন সভ্যতার বিকাশের ফলে ঘরে নির্যাতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাইরেও নির্যাতিত হচ্ছেন! বর্তমানে গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির ভয়াবহতা আমরা দেখতে পাই।
পৃথিবীর শুরুর দিকে কোনো গাড়ি বা গণপরিবহন আবিষ্কার হয়নি। সেসময় নারীরা যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে শুধু ঘরেই বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হতেন, সেই পরিস্থিতি আজও সমাজে বিদ্যমান। কিন্তু যখনই সভ্যতার বিকাশ ও নগরায়ণের কারণে গণপরিবহন ব্যবহারের অপরিহার্যতা তৈরি হলো এবং নারীদের ক্ষমতায়নের কারণে তাঁদের ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ল, তখন গণপরিবহনে যৌন হয়রানির বিষয়টি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হলো।
নারীরা বাসে ওঠার সময় বাসচালকের সহকারী ও অন্যান্য পুরুষ যাত্রী দ্বারা অযাচিতভাবে শরীরে বিভিন্নভাবে স্পর্শ, অশ্রাব্য ভাষায় নারীদের লক্ষ্য করে কটূক্তি, ফাঁকা বাসে নারীদের ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। শুধু তা–ই নয়, গাড়িতে ধর্ষণ করে সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ভুক্তভোগী নারীকে হত্যা করে নির্জন স্থানে ফেলে যাওয়ার মতো ঘটনার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।
৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার
ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশির ভাগ নারী, এর হার ৬৬। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি।
প্রতিনিয়ত নারীকে ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে। যেমন নগরে নারীর একা চলাচলে নিরাপত্তার অভাব। যানবাহনে চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অনিশ্চয়তা নারীর স্বাধীন চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ছাড়া অন্যান্য গণপরিবহনেও যাতায়াতকালে নারীরা অসম্মানজনক আচরণেরও শিকার হচ্ছেন। শুধু পরিবহনশ্রমিক, চালক, সহকারী নন, কখনো কখনো পুরুষযাত্রী দ্বারাও এ ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয় নারীদের।
গণপরিবহনে চলাচল করা কিশোরী, তরুণী ও নারীদের ৬৩ শতাংশ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়। যৌন হয়রানির শিকার এই নারীদের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক (৪৫ শতাংশ) পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানায় আঁচল ফাউন্ডেশন।
কারা যৌন নিপীড়ন করেছে জানতে চাইলে জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাঁরা অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০ শতাংশ চালকের সহকারী, ৩ শতাংশ হকার এবং ২ শতাংশ চালকের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
প্রায় ৬২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন, কিশোর ও যুবক অর্থাৎ ১৩ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারী যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় চালকের সহকারীদের নেমে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও তাঁরা বাসের দরজায় অবস্থান করে অযাচিতভাবে স্পর্শ করে বলে অভিযোগে এসেছে। প্রায় ৬১ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, ওঠা-নামার সময় সহকারীরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, ছয় মাসে অন্তত তিনবার তাঁদের এ ধরনের স্পর্শের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
গণপরিবহনে কোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার বেশি হয়েছেন জানতে চাইলে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, গণপরিবহনে অনেক সময় ফাঁকা জায়গা থাকলেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকাভাবে স্পর্শের শিকার হয়েছেন ১৮ শতাংশ। ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কার শিকার হয়েছেন ১৪ শতাংশ। প্রায় ১৪ শতাংশ কিশোরী-তরুণী জানিয়েছেন তাঁরা বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। হালকা ভিড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ এবং অতিরিক্ত ভিড়ে ২৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঝামেলা এড়াতে বেশির ভাগ নারীই প্রতিবাদ করেননি।
বাংলাদেশে যৌনশিক্ষা
খুব গভীরে চিন্তা করলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যৌনতাকে সুকৌশলে ভদ্রভাবে এড়িয়ে যাওয়ার অভদ্রতাই নারীদের জন্য গোটা দেশকে অনিরাপদ করে তুলেছে। স্বাভাবিক শিক্ষা না থাকায় বাংলাদেশিদের কাছে যৌনশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম পর্নোগ্রাফি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন শিশু ও তরুণদের যৌনাচার নিয়ে৷ তিনি বলেন, ‘‘স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাদের যৌনশিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই৷ যেটুকু আছে, তাও শিক্ষকরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ পরিবার থেকেও তারা যৌনশিক্ষা পাচ্ছে না৷ ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের পর্ণোগ্রাফির বই ও ভিডিও দেখে যৌনশিক্ষা পাচ্ছে৷ এই বইগুলোতে স্বাভাবিক কোন যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা নেই৷ সেখানে যা লেখা থাকে পুরোটাই বিকৃত যৌনাচার৷ এই কারণে তরুণরা ওই বইগুলো পড়ে বান্ধবী বা সহপাঠীর উপর পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করে৷ এই প্রবণতাটি খুব অল্পদিন হলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷’’
শুধু তরুণী নয়, ধর্ষক তরুণের সঙ্গেও কারাগারে কথা বলেছেন এই গবেষক৷ সেই অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে শুভ্রা বলেন, ‘‘ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত এক তরুণ তো কারাগারে আমাকে বলেই বসল, সে রসময় গুপ্তের গল্পের (পর্ণোগ্রাফির বই) নায়ক হতে চায়! যে সমাজে পিতা-মাতা, ভাই-বোন বলে কিছু থাকবে না৷ যেখানে থাকবে শুধুই যৌনাচার৷ অর্থাৎ তার কাছে যৌনাচারই হল পৃথিবী৷ অন্য কিছু তার মাথায় নেই৷ এটা সমাজের বাস্তব চিত্র৷’’
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘‘প্রত্যেকটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের জৈবিক চাহিদা থাকে৷ এটা কোন না কোনভাবে পূরণ হতে হয়৷ আমাদের দেশে দৌলতদিয়া ছাড়া আর কোন ব্রোথেল নেই৷ অথচ এটা সারা বিশ্বেই আছে৷ এগুলো না থাকায় দেখবেন আনাচে কানাচে কাজগুলো হচ্ছে চুরি করে৷ তরুণরাও প্রেমের নামে তরুণীদের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসছে৷ সেখানে এই কাজগুলো হরহামেশাই হচ্ছে৷ দু’একটি ঘটনায় ব্যতিক্রম হলে মিডিয়ায় হৈ চৈ হচ্ছে৷ আসলে আমরা কি তরুণ বা তরুণীদের যৌনশিক্ষা দিচ্ছি? পরিবারে মা সংসারের কাজের পাশাপাশি মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত, বাবা চাকরি বা ব্যবসা নিয়ে সময় পার করছেন৷ তাহলে শিশুটি কিভাবে বড় হচ্ছে৷ তার হাতে ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়েছেন৷ সেই ফোনে সে কী দেখছে? কেউ তার খোঁজ নিচ্ছে? এভাবে বেড়ে উঠা তরুণ বা তরুণী কী শিক্ষা পাচ্ছে?’’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘মাদকের সহজলভ্যতা, যৌনশিক্ষা না পাওয়া এবং ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না হওয়ার কারণে তরুণদের মধ্যে বিকৃত যৌনাচারের প্রবণতা তৈরী হয়৷ আমাদের কাছে এমন অনেক রোগী নিয়ে আসেন পিতা-মাতা৷ কিছুদিন আগে এক তরুণকে তার মা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন৷ ওই তরুণের পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি তৈরী হয়েছে৷ পরিবারের সদস্যদের অজান্তে লুকিয়ে সে পর্নোগ্রাফি দেখতে দেখতে ভয়াবহ আসক্ত হয়ে পড়েছে৷ আসলে স্কুল কলেজে যৌন শিক্ষাটা হওয়া জরুরি৷ পাশাপাশি পরিবার থেকে তরুণদের হাতে বিপুল পরিমান টাকা দেওয়ার কারণে তারা মাদকের প্রতিও ঝুঁকে পড়ছে৷ মাদকাসক্ত তরুণের পক্ষেই সম্ভব বিকৃত যৌনাচার৷”
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ